দেশে ফেরার লড়াই চালিয়ে যাবেঃ তসলিমা নাসরিন
বাংলাদেশের নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন
জানিয়েছেন, স্বদেশে
ফেরার অধিকার অর্জনের জন্য তার লড়াই থামবে না এবং বারবার প্রত্যাখ্যাত হলেও
বাংলাদেশি পাসপোর্ট নবায়নের জন্য তিনি চেষ্টা চালিয়েই যাবেন। আর দিন কয়েকের
মধ্যেই দেশ থেকে তার নির্বাসনের ২০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। এ উপলক্ষে বিবিসিকে দেয়া
একান্ত সাক্ষাত্কারে তসলিমা নাসরিন অভিযোগ করেন, ধর্মান্ধ একটা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর ভয়েই
শেখ হাসিনা, খালেদা
জিয়া বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেউই তাকে এতদিন দেশে ফিরতে দেয়নি। তার ব্যাপারে ঢাকার
সঙ্গে কথা বলতে ভারতের নতুন সরকারের প্রতি আহ্বানও জানান তিনি।
তসলিমা নাসরিনকে বাংলাদেশ ছাড়তে হয়েছিল ১৯৯৪
সালের মাঝামাঝি। তারপর সুইডেন-আমেরিকা-ফ্রান্স-কলকাতাসহ নানা দেশ, নানা শহর ঘুরে প্রায় তিন বছর তিনি
দিল্লিতেই আছেন। মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য দেশে ফিরতে চাই উল্লেখ করে তসলিমা
বলেন, যতোদিন
বাঁচব ততদিন আমার দেশে ফেরার লড়াই চালিয়ে যাবো। সেখানে থাকি বা না থাকি।
তসলিমা জানান, অধিকার আদায় করতে তিনি এখনো নিয়ম করে
কিছু দিন পরপরই মেয়াদ ফুরানো পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনে গেলেও তাকে
বারবার ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে এবং লিখিতভাবে আবেদন প্রত্যাখ্যানের কারণও জানানো হয়নি।
তিনি বলেন, শেখ
হাসিনা, খালেদা
জিয়া বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও তাকে দেশে ফিরতে
না দেয়ার ব্যাপারে তারা একমত। একইভাবে, পশ্চিমবঙ্গেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা
ব্যানার্জি সিপিএমের সব বিষয়ে প্রতিবাদ জানালেও তার বিষয়ে সিপিএমের সঙ্গে তার
কোনো বিরোধ নেই- জানান তসলিমা। তসলিমার বিশ্বাস বাংলাদেশে ধর্মান্ধ
গোষ্ঠীগুলোর দাপট কমছে না, বাড়ছে; কিন্তু এদের ভয়ে কেন সরকার তাকে দেশে ফিরতে দেবে না, এটাই তার বোধগম্য নয়।
* ইত্তেফাক থেকে===============
প্রবাসীর কোন দেশ নেই ][ মুনজের আহমদ চৌধুরী
প্রবাসীরা যখন দেশে ফেরেন তখন একই সুতোয় বাঁধা কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হন সবখানে। কোনদিন এলেন, কদিন আছেন, ফিরছেন কবে? আমাদের অনেক প্রবাসী দুরপ্রাচ্যে বা ক্ষেত্রবিশেষে মধ্যপ্রাচ্যে থিতু হয়ে গেছেন, পেয়েছেন সোনার হরিণসম ফরেণ পাসপোর্ট। ব্রিটেন,আমেরিকার পাসর্পোটের জন্মস্থান বা প্লেইস অব বার্থের কলামে তাঁরা আজীবন-আমৃত্যু বয়ে বেড়ান বাংলাদেশের নাম। এসব প্রবাসী পরবাসীদের পরের প্রজন্ম, যাদের জন্ম ব্রিটেনে তাদের দেশ কিন্তু ব্রিটেন। এদেশে তাদের জন্ম, বেড়ে উঠা, স্কুল, শৈশব-কৈশোর বন্ধুতা মুগ্ধতা সব। বাংলাদেশ তাদের কাছে বাবার দেশ-মায়ের দেশ, হলিডে কাটানোর ক্ষেত্রে তালিকার নিচের সারিতে পড়ে থাকা গন্তব্যের নাম।
যাঁরা প্রবাসে প্রথম প্রজন্ম। আমার বা আমাদের মতো, এখন বড়ো সবিস্ময়ে আর হৃৎহারী অপার বেদনায় দেখি আমার মতো আমার পুর্বসুরী অনেকের এখন কোন দেশ নেই। যারা আমাদের মতো জন্ম থেকে ছোটবেলা আর বড়বেলার অনেকখানি পার করে এসেছেন বাংলাদেশে, তারা জানেন দেশ ছেড়ে এই পরবাসে পড়ে থাকবার যাতনা আর বেদনা কতখানি। এইসব নিঘুর্ম স্বপ্নের দেশে জীবন আর জীবিকার তাগিদে আমরা থাকি বটে, কিন্তু হৃদয় জুড়ে থাকে প্রিয় দেশমাতৃকা, প্রিয়তমা বাংলাদেশ। এই পরবাস এই দুরপ্রাচ্য কিংবা মধ্যপ্রাচ্য আমাদের অর্থ, সচ্ছলতা কিংবা বেচেঁ থাকবার নির্ভরতা দেয় নি:সন্দেহে। কিন্তু যাপিত দীর্ঘ থেকে দৈর্ঘ্যতর পরবাস কখনোই আমাদের অনেকের নিজের ‘দেশ’ হয়ে উঠতে পারেনি, পারেনা। ভালো আর মন্দের আপেক্ষিকতার চিরকালীন দ্বন্দসমাসের মতো আবেগের অন্ত:বাসে তাঁেদর হৃদয় জুড়ে রয় বাংলাদেশ।
পরবাসের শুরুতে প্রবাসীরা দেশে সম্পদ আর জমি কেনায় মনোযোগী হন। একসময় দেখা যায় এই সম্পদ হয়ে দাড়ায় স্বজন-প্রিয়জনেরই লোলুপ চোখের লক্ষবস্তু। এভাবে সম্পদ রূপ নেয় সমস্যায়। পরবাসে নির্ঘুম রাত্রি আর ঘুমময় দিনের পাজরভেজা পরিশ্রমও যখন প্রিয়জনদের চাহিদা মেটাতে অপারগ হয়ে পড়ে তখন বোধকরি বাকী থাকবার মতোন থাকে না আর কিছুই। আর প্রবাসীদের এখনকার পরবর্তী প্রজন্মের বেশিরভাগই চান, বাবার সব দেশে পড়ে থাকা সম্পদ বিক্রি করে টাকাটা এখানে পরবাসেই নিয়ে আসতে। কী লাভ,পড়ে আছে, মানুষ খাচ্ছে। ভাবি হ্যাঁ অবশ্যই এ চিন্তা তো যুক্তির বিচারে সংগতই।
এই পরবাস শেষে শেষ ইচ্ছায় অনেক প্রবাসীর লাশ যায় দেশে, শেষ ঘুমের মতোন না ফেরার দেশে এবং প্রিয় বাংলাদেশে। অনেকের লাশ দেশে নিয়ে যাবার জটিলতা, লাশের সাথে দেশে যাবার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা আর আর্থিক বিবেচনায় তাও যায় না। তাদের অনিচ্ছার শেষ ঘুমের দেশ হয় পরবাসই।
============
আহা বিদেশি বাতাস!][ আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
ভাগ্যচক্রে অনেক বাঙালি লেখককে প্রবাসী হতে হয়েছে৷ দীর্ঘদিন বিদেশে আছেন কেউ কর্মসূত্রে, কেউবা স্থায়ীভাবে অভিবাসী৷ ভিন্ন ভূগোলের আবহাওয়া তাঁদের ওপর প্রভাব ফেলেছে৷ এই লেখকদের শরীর বিদেশে থাকলেও মন পড়ে থাকে দেশে৷ স্বদেশ-সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কের এই ধরনের ফলে বদল ঘটেছে তাঁদের ভাষাভঙ্গিতেও—তাঁরা হয়ে উঠেছেন ‘ডায়াসপোরা লেখক’৷ আর এসবের ভেতর দিয়ে সাহিত্যের যে নতুন অভিব্যক্তি গড়ে উঠছে, তার রূপটি কেমন? প্রবাসী লেখকদের ভাবনা ও লিখনশৈলীর পরিচয় তুলে ধরতেই এই আয়োজন
এই যে একটি বিদেশ, আমি চাই বা না চাই আমাকে সে তার হাওয়া-বাতাসের সঙ্গে প্রতিদিন জোর করে জড়িয়ে নিচ্ছে। কিন্তু আমি যে স্বেচ্ছায় দ্বীপান্তরিত, পালিয়ে পালিয়ে তার প্রাণটাকে কতটুকুই বা ধরতে পারলাম। আজ কত দিন হয়ে গেল বিদেশে থাকছি! থাকা বলতে যদি শারীরিক শর্তটাকে একমাত্র সত্য মানি, তখন এই থাকাটাকে একটু সহনীয়, একটু মায়াবী করা যায় হয়তো! আর মানসিকভাবে থাকা—সে যেন পুরাণের সিসিফাসের পাথর কুড়িয়ে আনার মতো একটা অনন্ত মধুর শাস্তি! আমি এই বোধ নিয়ে একটি ট্র্যাজেডির মধ্যে খেলা করেছি অনেক দিন। নিয়তির বিশ্বাসঘাতকতা হোক বা না হোক, যেকোনোভাবেই আজ এই ভীষণ বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে পড়েছি। ইচ্ছে করলে তো আকাশটাকে অতিক্রম করতে পারি, কিন্তু না পারাটাও আরও একটি ভয়াবহ অদৃশ্য শক্তি, শুধু পেছন থেকে টান দিয়ে ধরে। যেন ‘টু বি অর নট টু বি’। দেয়ালের পাশেই ঘাতক কিন্তু তাকে বধ করব কি করব না সেটি ভাবতে ভাবতে নিজেই রক্তাক্ত, ছিন্নভিন্ন (বাঙালি হ্যামলেট!)।
মাঝেমধ্যে আমার কাছে মনে হয়েছে, কবি হিসেবে বিদেশ থাকা একটি মহা আজগুবি ব্যাপার, একটি ধাঁধা, ঘূর্ণমান প্রহেলিকা। কারণ এমন এক জায়গায় থাকা যেখানে শুধু ভূ-প্রাকৃতিক জগৎ, বাসাবাড়ি অপর নয়, ভাষাও অপর। ভিন্ন আকারের, ভিন্ন রঙের মানুষজনের কথা নাইবা বললাম। তাই প্রশ্ন জাগে, বিদেশে কি বাংলা কবিতা লেখা যায়? লেখা যায় কি গল্প-উপন্যাস?
হয়তো লেখা যায়, ছদ্মবিদেশি, হাফ ভিনদেশি হয়ে লেখা যায়! যেমন সবাই তো লিখছি আমরা। কীভাবে লিখছি? এই জায়গায় একমাত্র সহায় আমাদের অনন্ত স্মৃতিবাক্স—হ্যারল্ড পিন্টার যেমন বলেছিলেন। স্মৃতি তখন এক জীবন্ত দেশের মতো চোখের সামনে খেলা করে, স্মৃতি তখন একটি অবিনশ্বর স্বদেশ-চৈতন্য, একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ চরিত্র যেন। তার কাছে ফিরে যাওয়া আর ফিরে তাকানো ছাড়া গতি নেই। তার হাত ধরেই গড়ে ওঠে প্রতিদিনের স্বপ্নচূর্ণ, জীবনবাস্তব বা পরাবাস্তবতা। তার থেকেই যেন কবিতার ভাষা আর একটি নতুন প্রেক্ষাপটে নিজেকে পুনর্নির্মাণের প্রাণ পায়। আর এক দেশের মাটি, জলবায়ু, গাছপালা মানুষজনের সঙ্গে লেখকের নিজস্ব যাপিত সময়ের ক্ষণিক মিথস্ক্রিয়া ঘটে। তখন স্মৃতির বিভিন্ন কানাগলি খুলে যায়, কবিতার সাইকেল চলে, গল্পের ঘুড়ি ওড়ে। একটি কবিতা যেভাবে মনের মধ্যে বাসা বাঁধে, তার ভেতরে তো আগের দেশের ভাষার মর্মমূল, সে দেশের মা-মাটি-মানুষ নীরবে একটি যোগাযোগ-পত্তন গড়ে তোলে। কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রেও প্রায় একই বাস্তবতা বটে। বিদেশে তো দেশের তেমন কোনো ঐতিহ্য নেই, কৃষ্টি-কালচারও নেই। তাই কীভাবে আমরা সেই পরিচিত দৃশ্য-অদৃশ্য বস্তু-অবস্তু, ঐতিহ্যঘেঁষা জ্ঞান-সংস্কারের কাছে যাই, তার স্পর্শ পাই?
তার একটি উপায় হলো স্মৃতির দিকে মনের দরজাটি খুলে রাখা। কিন্তু বিষয়টি এত সহজ নয়। এমতাবস্থায় কিছু ভাবনা মাথায় এল। সেগুলো নিচে সাজিয়ে ধরলাম।
একটি দেশকে তখনই বিদেশ মনে লাগে, যখন এর লোকজনের মুখের ভাষা, বই-পুস্তকের ভাষা ভিন্ন হয়। লোকজন একসঙ্গে থেকেও ভিন্ন সংস্কৃতি বা ধর্মের হতে পারে। কিন্তু এর ভাষা যদি এক হয় তাহলে চালচলনে, জীবনযাপনে, কবিতা-গল্প-উপন্যাস ইত্যাদির ভাব ভাবনায় খুব একটা অসুবিধা হয় না। এটি ঠিক যে বিদেশের আলো-বাতাস, নদ-নদী, ফুলমূল, পশুপাখি দেশের মতো প্রায় একই। এমনকি এর ল্যান্ডস্কেপও। কিন্তু যেহেতু এদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের ওঠা-বসা নেই, জড়িয়ে পড়া নেই, তাই এগুলো তেমন করে আপন লাগে না। দেশের একটি পাহাড় বিদেশের একটি পাহাড়ের মতো দেখতে হলেও শুধু দূর দেশ হওয়ার কারণে, বোঝাপড়ার অভাবের কারণে অপরিচিত লাগে। তাই বিদেশ একটি ধারণা নয় অবশ্য। কারণ বিদেশ অধিকাংশ সময়ই ফিজিক্যাল, খুব অ্যাগ্রেসিভ। যে এর মধ্যে থাকে, সে তখন এর আক্রমণমুখর ভূ-বাস্তবতার মধ্যে নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়, এর ডাইনামিজম সে সময় ঘা দেয় আরও বেশি। বিদেশ তখন সুযোগ নিয়ে খুব লম্বা করে পা ছড়িয়ে আয়েশ করে চোখের সামনে থাকে। পালানোর কোনো জো নেই সেখান থেকে।
বিদেশ স্বদেশ হয় না, কারণ আমি এখানে জন্মগ্রহণ করিনি—এমন ভাবনার মধ্যে পুরো সত্য লুকানো থাকে না সব সময়। কারণ জন্ম নেওয়ার মধ্যে নিজের রক্তমাংস ছাড়াও আত্মার সঙ্গে নিজ দেশের লম্বা শিকড় এসে জোড়া লাগে, গহিন বন্ধনে জড়িয়ে থাকে ওরা। বন্ধনটি হাজার হাজার বছরের। সেই কারণে শুধু হঠাৎ জন্ম নেওয়ার সঙ্গেও বিদেশকে দেশ বানানোর সুযোগ থাকে না। সেই মোতাবেক মা-বাবার জন্মদেশই শিশুর দেশ হয়। কিন্তু শিশু যদি একটি বিদেশের জল-আবহাওয়া-বিশেষত এর ভাষা-সংস্কৃতিতে বংশপরম্পরায় বড় হতে থাকে, তাহলে হয়তো বিদেশ দেশ হওয়ার সুযোগ থাকে। কারণ তখন নিজ দেশ বলতে তার মাথায় কোনো স্মৃতিগাছ থাকে না, যেমন আছে আমাদের, ফলমূল ছায়াসমেত। তাই প্রবাসী হিসেবে প্রথমে যে কালচারাল শকিং হয়, তার মধ্যে নিজ ভাষার সঙ্গে বিচ্ছেদটি বাঙালি কবি-লেখককে একটি চ্যালেঞ্জের সামনে ছুড়ে দেয়। আর একে অতিক্রম করা এবং অতিক্রম করে বাংলায় সাহিত্যচর্চা করতে হলে তাকে নতুন করে আর একটি দুরূহ পথের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হয়। তাকে তার স্মৃতি-ঘটনা, ভাষা-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য ইত্যাদিকে পুনর্বিন্যাস করতে হয়, একটি অদৃশ্য টানেল খুঁড়ে সেখানে যাতায়াত করতে হয়।
আজ আমরা মুখেমুখে যতই জিয়ো-পোয়েটিক্স বা জিয়ো-লিটারেচারের কথা বলি না কেন, বাঙালি কবি-লেখক মানসিকভাবে নিজ দেশের ভাষা, মানুষ, প্রকৃতি আর ঐতিহ্যনির্ভর। তার চিন্তা-প্রক্রিয়া এখনো সম্পূর্ণভাবে স্বদেশবিচ্ছিন্ন হয়ে কেবল ব্যক্তিগত চকিত অভিজ্ঞতা, একান্ত বস্তুঘন সত্তার চূর্ণপ্রভা প্রকাশমাধ্যম হয়ে উঠতে পারেনি। তার চিন্তার সঙ্গে তার দেশ সব সময়ই অবিচ্ছিন্নভাবে একটি অদৃশ্য রক্তবন্ধন গড়ে তুলেছে। সে সব সময়ই স্বদেশমুখী, তার সজ্ঞায় তার মাতৃমূর্তি তথা মাতৃভাষা কখনো দুগ্ধফোঁটা কখনো সমুদ্রের উত্তাল স্রোতের মতো হানা দেয়। মাইকেল মধুসূধন দত্ত, অমিয় চক্রবর্তীসহ হাল আমলের যাঁরা বিদেশ থেকে সাহিত্যচর্চা করছেন তাঁদের লেখায় আমরা এ জিনিসটি লক্ষ করেছি। কিন্তু তার পরও বিদেশ ছলনাময়ী প্রেমিকার মতো কখনো কখনো তার মায়াবী দেহ আর চোখের ইশারায় বাঙালি কবি-লেখককে যে আত্মহারা করেনি সেটিই বা অস্বীকার করি কীভাবে। তার থেকে যেসব কবিতা-গল্পের জন্ম হয় সেটিকে আমরা জিয়ো-পোয়েটিক্স বা বায়ো-পোয়েটিক্স—সব মিলিয়ে জিয়ো-লিটারেচার যাই বলি না কেন, তা যে একটা কিছু হয় তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সামাজিকতার এত দূর আর দুর্বোধ্য আচরণ, এত অপরিচিতির পাষাণময় বিচ্ছুরণ তার ভেতরেও কিছু নির্ভরতা, কিছু চোরা জলাশয় হয়তো কোথাও আছে—যার মাধ্যমে কিছু উপশম, আরাম পাওয়া যায়। আমরা যে বয়সে এখানে এসেছি সেখানে আর হয়তো এই বিদেশ তার ‘বিদেশিত্ব’ নিয়ে চরম হামলাটি করবে না। আমাদের গলে পড়া, ঘুমিয়ে থাকা মগজে নিজের দেশ, সংস্কৃতি, মা-মাটি-মানুষ—সবই জলছাপের মতো ঘর করে আছে। প্রয়োজন শুধু একে নতুন জন্মগ্রহণের স্বাদ-গন্ধ দিয়ে জাগিয়ে তোলা, ভাসিয়ে তোলা। আর এই বয়সে এই পরদেশ তো কিছু দিতে বা নিতে পারবে না। আবার বিদেশে থেকেও ‘বিদেশ-বিদেশ’ না লাগার কারণ পৃথিবীব্যাপী ই-কাগজ, ই-সংস্কৃতির ছড়াছড়ি। শারীরিকভাবে হয়তো এর কিছুই দেখতে পারছি না, কিন্তু অনুভব আর চিন্তাচেতনায় দেশ তার আলো-আঁধারি মাঠঘাঠ, দোকানপাট মাঝিমাল্লা, গরু-মহিষ, সাইকেল-রিকশা ভিড়বাট্টাসহ আরও জ্যান্ত একটি ফিগার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
এই যে আন্তর্জালিক, ভার্চুয়্যাল ওয়ার্ল্ড, এই যে দেশ, দেশের মানুষের ছবি, কথা, লেখালেখি—তাও কিন্তু গোপনে গোপনে একটি ছোট ‘ভাষাদেশ’ গড়ে যায় নিজের ভেতর। নিজ ভাষার একটি নীরব ঘর হয়ে উঠছে এই জগৎ। তা দিয়ে ভাষাগত দূরত্বের বিষয়টি আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসছে, আস্তে আস্তে নতুন কবিতা-গল্প-উপন্যাস—এসবের জন্ম হচ্ছে। তাই হতাশ হয়ে নয়, নিজেকে আবার নতুনে ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় বলি, ওপরে খোলা আকাশ, নিচে কোটি পাথরবেড়া আর সেই কারণে দূরের দেশ আজ আমার সামনে আরও জ্যান্ত আরও স্বয়ংপ্রকাশ। যদিও আমি কোনো দিন বলতে পারব না, ‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও, আমি এই বাংলার পারে রয়ে যাব’, তবুও আমার রক্তের মধ্যে নিহিত, আমার জিনকোডে লিখিত নিজ দেশের হাজার বছরের ঘুমিয়ে থাকা লক্ষ-কোটি যাপিত জীবনের সুরগুলো, দৃশ্যগুলো—এই বিদেশে নতুন করে পাওয়া ভাব-ভাবনার সঙ্গে মিলেমিশে আরও এক নতুন ভাষা-ভাবনার কবিতার টানেল তৈরি করছে দিনরাত। সেই লোভ, সেই শান্তি!!
*দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০৬, ২০১৪, ঢাকা থেকে।
========== =============
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন