অনুবাদ



 পাবলো নেরুদা ক'টি
কবিতা

অনুবাদ: 
কামাল রাহমান





(চিলির বিখ্যাত কবি নেফতালি রিকার্ডো রেইয়েস ব্যাসোয়াল্টোর জন্ম ১৯০৪এ এবং মৃত্যু ১৯৭৩এ। বিখ্যাত চেক কবি আয়ান নেরুদাকে মনে রেখে নিজের জন্য লেখনী নাম বেছে নেন পাবলো নেরুদা। তরুণ বয়সেই কবিখ্যাতি অর্জন করেন। কাব্যকলার বিভিন্ন শৈলীতে পারদর্শীতা ছিল তাঁর। পরাবাস্তব শৈলীর অসাধারণ ব্যবহার করেছেন তিনি। উত্তেজক প্রেমের কবিতায় তাঁর মুন্সীয়ানা ছিল প্রবাদপ্রতীম। টুয়েন্টি লাভ পোয়েমস এন্ড এ সং অব ডিসপেয়ারএরকম একটি কবিতাগ্রন্থ। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কলম্বিয়ার বিখ্যাত ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তাঁকে বিশ শতকের সেরা কবি হিসেবে অভিহিত করেন। রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। চিলির কমিউনিস্ট পার্টির একজন প্রথম সারির নেতা হিসেবে আজীবন সক্রিয় ছিলেন। চিলির স্বৈরশাসক অগাস্টো পিনোশের মতা গ্রহণের পর আকস্মিকভাবে নেরুদাকে হাসপাতালে শয্যাশায়ী হতে হয়। মারাত্মক কর্কট ব্যাধির আক্রমণে ধরাশায়ী হন তিনি। এর তিন দিন পর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান তিন। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে স্বৈরশাসকের প্রত্য অথবা পরো যোগ-সাজশ থাকার প্রকাশ্য অভিযোগ আনা হয়। সমাজবাদী প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দের একজন ঘনিষ্ঠ সহচর ও উপদেষ্টা ছিলেন পাবলো। হান্ড্রেড লাভ সনেটস’ ,‘দ্য ইয়েলো হার্ট’, ‘স্টোনস অব দ্য স্কাই’, ‘স্টিল এনাদার ডেপ্রভৃতি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ।)

প্রগাঢ় এক ভালোবাসার আগুন
-------------------
প্রেম
কি সমস্যা তোমার, বল তো?
হয়েছে কি আমাদের ভেতর?
তোমার ভালোবাসা, সে-তো এক কঠিন শেকল
বেঁধে ফেলছে শুধুই। আহত করছে আমাদের, এবং
যদি চাই এড়িয়ে যেতে,
যদি চাই পৃথক হতে,
আরো একটা নতুন গেরো এঁটে দেয় ওটা তখন,
দোষী করতে আমাদের, এবং নিংড়ে নিতে আমাদের রক্ত
এবং পোড়াতে আমাদের।
সমস্যাটা কি তোমার? তাকাই আমি তোমার দিকে
অথচ খুঁজে পাই না কিছুই, কেবল দুটি চোখ,
অন্য সব চোখের মতো! একটা মুখ,
ওটাও হারিয়ে যায় অন্য হাজারটা মুখের মতো,
একটা শরীর, ওরকম আরো অনেকের মতো, যেখানে ঘুমিয়েছি আমি,
শরীরের নিচে কোনো স্মৃতি না রেখে।
এবং কত বেশি শূন্য তুমি, পেরিয়ে যাও এই পৃথিবী
গমের রং একটা পাত্রের মতো,
বাতাস ছাড়া, শব্দ ছাড়া, বস্তু ছাড়া!
আমার আলিঙ্গনের জন্য বৃথাই খুঁজেছি উষ্ণ এক
গভীরতা তোমার ভেতর
কোথাও না থেমে শুধু খননই করে ওটা, ভুতলের নিচে:
তোমার ত্বকের নিচে, তোমার চোখের নিচে।
কিছু নেই
জোড়া-স্তনের নিচে তোমার,
কিছুটা উদ্ধত এখন,
স্ফটিক জমানো বিদ্যুৎ ওখানে
জানে না কেন বয়ে যায় এটা কোনো এক গানের সুর হয়ে।
কেন, কেন, কেন,
প্রিয় আমার, কেন?

তোমাকে ভালোবাসার কারণ ছাড়া অন্য কোনো
কারণে ভালোবাসি না তোমাকে
--------------------------------------------------
তোমাকে ভালোবাসার কারণ ছাড়া অন্য কোনো কারণে ভালোবাসি না তোমাকে
সরে যাই, তোমাকে ভালোবাসা হতে ভালো-না-বাসায়
তোমার জন্য অপেক্ষা করা হতে অপেক্ষা না-করায়
পাল্টে যায় হৃদয় আমার হিম হতে আগুনে

শুধু তোমাকেই ভালোবাসি আমি, কারণ এটা সেই তুমি, যাকে ভালোবাসি আমি
গভীরভাবে ঘৃণাও করি তোমাকে, এবং তোমাকে ঘৃণা করে
আণত হই তোমারই কাছে, এবং তোমার জন্য আমার ভালোবাসা বদলে যাওয়ার পরিমাণ
হল, যে তোমাকে দেখি না আমি, কিন্তু ভালোবাসি অন্ধভাবে।

হয়তো বর্ষশুরুর আলো উপভোগ করবে তুমি
অথচ আমার হৃদয় ওটার নিষ্ঠুর
কিরণ সহ আত্মসাৎ করে সত্যি এক শৈত্য।

কাহিনীর এ অংশে একমাত্র আমিই ভালোবাসার জন্য
হয়েছি মৃতপ্রায়। মরেই যাবো আমি, কারণ তোমাকে ভালোবাসি আমি,
কারণ তোমাকে ভালোবাসি আমি, ভালোবাসি, আগুনে ও রক্তে।

যদি ভুলে যাও আমাকে
------------------
আমি চাই, তুমি জানো
ঐ বিষয়টা।

তুমি জানো এটা কেমন:
যদি তাকাই
স্ফটিক ঐ চাঁদের দিকে, আমার জানালায় নুয়ে থাকা
ধীরে চলা শরতের লাল আগুন-রং ঐ বৃক্ষশাখায়,
যদি ছুঁয়ে দেই আমি
ঐ আগুনের কাছে
স্পর্শাতীত সাদাভস্ম
অথবা বৃক্ষকাণ্ডের অস্থির ত্বকের কুঞ্চন
সবকিছুই নিয়ে যায় আমাকে তোমার কাছে,
যেনো সবকিছুরই অস্তিত্ব ওখানে, যেভাবে
সুগন্ধি, আলো, ধাতু, সবকিছু হয় অস্তিত্ববান,
ছিল ছোট্ট এক নৌকো
যা পাল তোলে

তোমার ঐ সব দ্বীপ উপদ্বীপের প্রতি, যেগুলো অপেক্ষায় থাকে আমার জন্য
-------------------------------
বেশ তো, এখন, একটু একটু করে যদি থামিয়ে দাও তোমার ভালোবাসা
আমিও থামিয়ে দেবো একটু একটু করে তোমাকে ভালোবাসা

যদি অকস্মাৎ
ভুলে যাও আমাকে
তাকিও না আমার জন্য
আমিও তখন ভুলে গেছি তোমাকে।

যদি ভাবো এটা দীর্ঘ ও পাগলপারা
এক বায়ু-ধ্বজা
যা অতিক্রম করে জীবনের ভেতর দিয়ে আমার
এবং তুমি সিদ্ধান্ত নাও
ছেড়ে যাবে হৃদয়ের ঐ উপকূলে,
যেখানে রয়েছে আমার শেকড়

মনে রেখো
ঐ দিন
ঐ মুহূর্তে
উঠিয়ে নেবো আমার হাত
এবং, বিচ্ছিন্ন হবে আমার শেকড়
অন্য কোনো ভূমির প্রত্যাশায়।

কিন্তু,
যদি প্রতিটা দিন
প্রতিটা ঘণ্টা
অনুভব করো তুমি, যে অচ্ছেদ্য সব মধুর অনুষঙ্গ সহ
তোমার নিয়তির একমাত্র গন্তব্য আমাতে,
যদি প্রতিদিন একটা ফুল
উঠে আসে তোমার ঠোঁটে, অন্বেষণ করে আমাকে,
আহা, ভালোবাসা, আমার নিজস্ব ভালোবাসা,
যে আগুন জ্বলে ওঠে বারবার,
বিলুপ্ত হয় না কোনো কিছুই আমাতে, অথবা হয় না বিস্মৃত
ভালোবাসা পূর্ণ হয় আমার, তোমার ভালোবাসায়। প্রিয়তমেষু,
যে পর্যন্ত এটা ধারণ করো তুমি, থেকে যাবে এটা তোমার বাহুডোরে
কখনোই খুলে যাবে না বাহুবন্ধন আমার।

দূরে যেও না, এমনকি একদিনের জন্যও না
----------------------------
দূরে যেও না খুব বেশি, এমনকি একদিনের জন্যও না, কারণ,
কারণ-- জানি না কীভাবে বলতে হয় এটা। অনেক দীর্ঘ একটা দিনও
অপেক্ষা করে থাকবো তোমার জন্য, যেমন থাকে একটা জনশূন্য স্টেশনের
ট্রেনগুলো, অন্য কোনোখানে, ঘুমন্ত।

ছেড়ে যেও না আমাকে, এমনকি একটা ঘণ্টার জন্যও, কারণ
তীব্র বিষাদের ছোটো ছোটো ফোঁটাগুলো তখন গড়াতে থাকবে সব একসঙ্গে
ভেসে আসবে একটা আবাস খুঁজে বেড়ানো ধোঁয়া
আমার ভেতর, গুড়িয়ে দিতে আমার হারানো হৃদয়।

যেনো কখনোই বিলুপ্ত হয়ে না যায় তোমার দেহরেখা, আহা,
যেনো কখনোই শূন্যতায় বিম্বিত না হয় তোমার চোখের পাতা
ছেড়ে যেও না আমাকে, প্রিয়তম আমার, একটা মুহূর্তের জন্যও না

কারণ, যে মুহূর্তে দূরে চলে যাবে তুমি
সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াবো আমি উ™£ান্তের মতো, জিজ্ঞেস করবো,
ফিরে আসবে কি? ছেড়ে যাবে আমাকে এখানে, অন্তিম প্রয়াণের জন্য আমার?

মাতালের মতো মাতাল
----------------
সামান্য একটু তারপিন খেয়েই এক মাতালের মতো মাতাল হয়েছি
তোমার উন্মুক্ত ওষ্ঠ-ছোঁয়ায়,
ভেজা শরীর তোমার আটকানো এক কীলকে
আমার ভেজা শরীরের, এবং দোলে
আমাদের নৌকো, বানিয়েছি যা ফুল দিয়ে।
তুমুল উপভোগ, চালিয়ে যাই এটা - আমাদের আঙ্গুলগুলো,
হলুদ ধাতু দিয়ে গড়া অলঙ্কারের মতো-
আকাশের উষ্ণ, গোলাকার প্রান্তের উপর,
দিনের শেষ নিঃশ্বাস, আমাদের পালের উপর

অয়নাংশের মাঝখানে সূর্য দিয়ে গাঁথা,
বিষুবরেখা, নিদ্রাতুর এবং ঢুলুঢুলু, একসঙ্গে
ভেসে যাই আমরা মাসের পর মাস, জেগে উঠি তারপর
ভূমির তিতে স্বাদ নিয়ে আমাদের ঠোঁটে,
চোখের পাতাগুলো আঠালো, চটচটে, প্রতীক্ষা করি একটা লেবুর জন্য
একটা আশা, কূপের ভেতর নামতে থাকে বালতি,
রশির শব্দ। রাত্রিতে তারপর,
আমরা উপস্থিত হই সৌভাগ্যের দ্বীপগুলোয়
শুয়ে থাকি মাছেদের মতো
চুমোর উজ্জ্বল আলোর নিচে।

সারাক্ষণ
----------------
ঈর্ষান্বীত নই আমি
যা আসে সামনে আমার।

নিয়ে আসো একটা পুরুষ
জড়িয়ে তোমার কাঁধে,
নিয়ে আসো একশোটা পুরুষ তোমার চুলে বেঁধে,
তোমার স্তন ও পায়ের পাতার মাঝখানে ধরে নিয়ে আসো হাজারটা পুরুষ
ডুবন্ত পুরুষে পূর্ণ
একটা নদীর মতো আসো
বয়ে যায় যারা বুনো সমুদ্রের দিকে
সময়ের সনাতন সাদাফেনায়!

আনো সবাইকে
---------------
তোমার জন্য যেখানে অপেক্ষায় রয়েছি আমি
সব সময়ই একা থাকবো আমরা,
সবসময়ই আমার শুধু তুমি আর আমি
একা এই বিশ্বে, যে-কোনো সময়
শুরু করতে আমাদের জীবন!

যুথবদ্ধ আত্মা
-----------------
এমনকি এই গোধুলি আলোয় হারিয়ে গেছি আমরা।
কেউ দেখে না আমাদের এই হাতে হাত ধরা
যখন নীল রাত নেমে আসে এই পৃথিবীতে।

আমার জানালা দিয়ে দেখেছি
সূর্যাস্তের উৎসব, দূরের পর্বত শিখরে।

সূর্যের একটা টুকরো কখনো
জ্বলতে থাকে হাতের তালুতে আমার, একটা মুদ্রার মতো।

তোমাকে মনে করি আমি যুথবদ্ধ আত্মা দিয়ে আমার
ঐ দুর্যোগের মধ্য দিয়ে, যা জানো তুমিও।

কোথায় ছিলে তাহলে?
অন্য কে আর ছিল সেখানে?
কেন প্রেমের সবটুকুই আসবে অকস্মাৎ আমার কাছে
দুঃখভারে যখন পীড়িত আমি এবং অনুভব করি তোমাকে অনেক দূরে?

গোধুলি আলোয় যে বইটা বন্ধ হয়ে যায় সবসময়
এবং নীল গাত্রাবরণ পড়ে থাকে আমার পায়ের পাতায়,
আহত একটা কুকুরের মতো

সবসময়ই, সন্ধ্যার মধ্য দিয়ে পিছিয়ে যাও তুমি
যে গোধুলি-আলো মুছে দেয় মূর্তিগুলোর প্রতিচ্ছায়া।

বিকেলগুলোর দিকে ঝুঁকে
---------------------
বিকেলগুলোর দিকে ঝুঁকে
মহাসমুদ্র সম তোমার চোখের উপর ছড়িয়ে দেই আমার দুঃখের জাল,
সেখানে নিঃসঙ্গতা আমার জ্বলে সর্বোচ্চ অনলে
ডুবন্ত এক মানুষ, হাতদুটো যার দীর্ঘায়িত উর্ধে, এবং জ্বলে অনির্বাণ শিখায়,
লাল আলোর সঙ্কেত পাঠাই আমি অন্যমনস্ক চোখের দিকে তোমার
দুলে ওঠে ওটা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো, বাতিঘরের উজ্জ্বল আলোর শিখায়
আলোড়িত করে এক নিবিড় সমুদ্র-তট
শুধুই অন্ধকার ধরে রাখো তুমি, দূরের নারী আমার;
তোমার শুভেচ্ছায় কখনো জেগে ওঠে কোনো এক সন্ত্রস্ত উপকূল।

বিকেলগুলোর দিকে ঝুঁকে
ছড়িয়ে দেই দুঃখের জাল আমার, ঐ সমুদ্রে যা পরাজিত।
মহাসামুদ্রিক চোখ দিয়ে তোমার
রাতের পাখিরা ঠোকরায় প্রথম তারাদের।
আমার আত্মার মতো ঝলকে ওঠে ওটা যখন ভালোবাসি তোমাকে।
রাত্রি, লাফিয়ে যায় চঞ্চল ছন্দে
ওটার ছায়াঘেরা প্রান্তরে, পুলকিত ভূমির উপরে, তীব্র ঐ নীল বেণি দুলিয়ে।

আলো জড়িয়ে রাখে তোমাকে
--------------------
আলো জড়িয়ে রাখে তোমাকে, মরণশীল শিখায়
বিমূর্ত, পাণ্ডুর শোকপালনকারীরা দাঁড়িয়ে থাকে ঐ পথে
গোধূলির জীর্ণ ঘূর্ণিচাকার বিপরীতে
ঘুরতে থাকে তোমার চারধারে

বাকহারা, বন্ধু আমার
মৃতের এই মুহূর্তগুলোয় একাকিত্বের ভেতর একা
আগুনের লেলিহান শিখায় পূর্ণ
নষ্ট দিনের সঠিক উত্তরাধিকার।

সূর্য হতে ঝরে পড়ে একটা ফল, আমাদের কালো পোশাকের উপর
রাত্রির মহান শেকড় অকস্মাৎ
জন্ম নেয় তোমার আত্মা হতে
যে-সব বিষয় ছিল লুকানো তোমাতে, বেরিয়ে আসে আবার
বিষাদে নীল, ও বিতৃষ্ণ এক মানুষ
নবজন্ম তোমার, গ্রহণ করে জীবনীশক্তি
জাঁকালো ও উর্বর, এবং চৌম্বকীয় দাস, আহা,
এক বৃত্তের, যা বদলে যায় পালা করে, কালো ও সোনালিতে,
ওঠো, একটা সৃষ্টির অধিকারী হও
এতো ধনী হও জীবনে, যেনো এটার ফুলগুলো ঝরে যায়, এবং
পূর্ণ হয় বিষাদে।

পায়ের পাতা তোমার
-----------------
তাকাতে পারি না যখন তোমার মুখের দিকে
তাকাই তোমার পায়ের পাতায়।
ধনুকের মতো কিছুটা বাঁকানো,
ছোট্ট পায়ের পাতা তোমার।
জানি, ওরা ধরে রাখে তোমাকে
শরীরের লোভনীয় ওজন তোমার
উঠে আসে ওদের উপর। 
তোমার কটিদেশ, স্তনযুগল,
এক-জোড়া বেগুনি উল্লাস
তোমার স্তনবৃন্তের,
তোমার চোখের কোটর
এইমাত্র ভেসে গেছে যা,
তোমার প্রশস্ত মুখ
লাল প্রবেশপথে তোমার
আমার ছোট্ট স্তম্ভ। কিন্তু,
আমি ভালোবাসি তোমার পায়ের পাতা
শুধু একারণে যে ওরা হাঁটে,
মাটির পৃথিবীর উপর দিয়ে এবং
বাতাসে ও জলে,
যে পর্যন্ত না ওরা খুঁজে পায় আমাকে।

=============
কে তোমার প্রকৃত বন্ধু?

ওশো রজনীশ

ভাষান্তরঃ অজিত দাশ


"প্রিয় ওশো আমার অনেক বন্ধু আছে, কিন্তু একটা প্রশ্ন আমার মনে প্রতিনিয়ত উদয় হয়, কে আমার প্রকৃত বন্ধু?' আপনি কি এ বিষয়ে আমাকে কিছু জানাবেন?"


তুমি আসলে ভুল জায়গা থেকে প্রশ্ন করেছো। কখনো নিজেকে জিজ্ঞেস করোনা কে তোমার প্রকৃত বন্ধু? জিজ্ঞেস করো আমি কি কারো প্রকৃত বন্ধু হতে পেরেছি? এটাই হবে যথার্থ প্রশ্ন। কেন তুমি অন্যকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হবে- কেউ তোমার ভাল বন্ধু হোক আর নাই হোক।

প্রবাদ বাক্য আছে- সুসময়ের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। কিন্তু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখবে  এতে লালসা আছে। এটা বন্ধুত্ব নয়, ভালবাসাও নয়। তুমি নিজের উদ্দেশ্যে অন্যকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছো। কোনো মানুষই অপরের উদ্দেশ্যের জন্য নয়। প্রতিটি মানুষ তার নিজের জন্যই। কেন তুমি এতটা উদ্বিগ্ন হও যে কে তোমার ভাল বন্ধু।

নববিবাহিত এক দম্পতি ফ্লোরিডার দক্ষিনাঞ্চলে ঘুরতে গিয়ে একটি বিষাক্ত র‍্যাটল স্ন্যাকের খামারের দেখা পেয়েছিলো। চারপাশ ঘুরে তারা খামারের মালিকের সাথে এক আলাপচারিতায় মগ্ন হলো।

নববিবাহিত তরুনিটই জিজ্ঞেস করলো, আপনি একটা মারাত্মক পেশা বেছে নিয়েছেন। আপনাকে কি কখনো সাপে কাটেনি?'
খামারের মালিক বললো,  'হ্যা কয়েকবার সাপে কেটেছে। '
তরুনিটি আরো জোর দিয়ে বললো, 'আপনাকে যখন সাপে কাটে তখন আপনি কি করেন?'

'আমি সবসময় একটা ধারালো ছুড়ি আমার কাছে রাখি। যখনি আমাকে সাপে কাটে ধারালো ছুড়ি দিয়ে সেই অংশটা কেটে বিষাক্ত রক্তটা বের করে নেই।'
কি?
আচ্ছা যদি কখনো দুর্ভাগ্যক্রমে আপনি সাপের খাচায় পড়ে যান তাহলে কি করবেন? তরুনিটি উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
লোকটি বললো,  তাহলে সেদিন আমি বুঝতে পারবো কে আমার ভাল বন্ধু।
কেন তুমি উদ্বিগ্ন হবে?
যথার্থ প্রশ্ন হচ্ছেঃ আমি কি কারো প্রকৃত বন্ধু হতে পারি? তুমি কি জান বন্ধুত্ব কি? এটা হচ্ছে ভালবাসার সর্বোচ্চ রূপ। ভালবাসায় একটা উদ্দেশ্য থাকে, কিন্তু বন্ধুত্বে সেটা অদৃশ্য হয়ে যায়।
বন্ধুত্বে কোনো দেনা-পাওনা অবশিষ্ট থাকেনা। এটা খুবি সূক্ষ্ম বিষয়। বন্ধুত্ব মানে অন্যকে নিজের উদ্দেশ্য ব্যবহার করা নয়। এটা অন্যকে নিজের প্রয়োজন ব্যবহার করাও নয়। এটা কোনো কিছু ভাগ করে নেওয়ার প্রশ্ন। তোমার অনেক কিছুই আছে কিন্তু তোমার ভাগ করে নেওয়া প্রয়োজন। তোমার গান, তোমার কৃতজ্ঞতা, তোমার ভাল লাগা, মন্দ লাগা। তাকে গুরুত্ব দেওয়া। এটা নয় যে সে তোমাকে কতটা গুরুত্ব দিলো সেই হিসেব করা। একজন বন্ধু সবমুহূর্তেই তার বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে।

তুমি কি জান? ভালবাসায় একধরনের লালসা আছে। তুমি জানলে বিস্মিত হবে সংস্কৃত শব্দ লোভ থেকেই ইংরেজী ‘love’ শব্দের উৎপত্তি। কিভাবে লোভ থেকে ‘love’ হলো এটা একটা ভয়ানক গল্প। সংস্কৃতে লোভ মানে লালসা। আর ‘love’ লালসা ছাড়া কিছুই নয়। ভালবাসার গভীরে লালসাই বিরাজ করে।

অন্যকে ব্যবহারের কথা মাথায় রেখে বন্ধুত্ব করা একটি ভুল পথে পা বাড়ানো ছাড়া আর কিছু নয়। বন্ধুত্ব পারস্পারিকতার বিষয়। তোমার যা কিছু আছে তা অপরকে জানানো। আর যে জানতে প্রস্তুত সেই তোমার বন্ধু। এখানে প্রয়োজনের কোনো প্রশ্ন উঠবেনা। এটা এমন কোনো প্রশ্নের বিষয় নয় যে তুমি বিপদে পড়বে আর তোমার বন্ধু এসে তোমাকে সাহায্য করবে। এটা চিন্তা করা অপ্রাসঙ্গিক। সে আসতেও পারে নাও আসতে পারে। যদি সে নাও আসে তাতে তোমার অনুযোগ থাকার কথা নয়। তুমি তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারনা।  যদি সে আসে তুমি কৃতজ্ঞ। যদি সে না আসে তাহলেও পুরোপুরি সঠিকভাবে বিষয়টিকে মেনে নাও। কেননা এটা তার সিদ্ধান্ত সে আসবে কি আসবে না। তুমি তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারনা। তোমার কোনো ক্ষোভ থাকারও কথা নয়। তোমার তাকে এটা বলাও উচিত নয় যে- 'যখন আমি বিপদে ছিলাম তুমি আমাকে সাহায্য করনি।'

বন্ধুত্ব কোনো বাজারি বিষয় নয়। বন্ধুত্ব এমন একটা বস্তু যা মন্দিরের সাথে সম্পর্কযুক্ত, বাজারের সাথে নয়। কিন্তু তুমি এ ধরনের বন্ধুত্বের প্রতি মনযোগী  নও। তোমাকে তা শিখতে হবে। 

বন্ধুত্ব একটি মহৎ শিল্প। ভালবাসার ভিতর একটি প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি আছে। বন্ধুত্বের মধ্যে তা নেই। বন্ধুত্ব সচেতনতার বিষয়। ভালবাসা সচেতনার বিষয় নয়। তুমি একজন নারীর প্রেমে পড়লে। কেন আমরা বলি মানুষ প্রেমে পড়ে? এই বাক্যটা লক্ষনীয়। 'প্রেমে পড়া'। এমন নয় যে তোমার  মধ্যে প্রেম ছিলোনা। কেউ প্রেমে পড়ে বলেনা আমার প্রেম বেড়েছে। সবাই প্রেমে পড়ে। কেননা এটা সচেতনতা থেকে অবচেতনায় যাওয়া। বুদ্ধিমত্তা থেকে প্রবৃত্তিতে গিয়ে পড়া। 

ভালবাসায় মানবিকতার চেয়ে পশুত্বই বেশি। বন্ধুত্ব পুরোপুরি মানবিক। বন্ধুত্বের জন্য জৈবিক প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না। এটা সম্পূর্ণ অজৈবিক। তাই কেউ বন্ধুত্বে পড়ে না। বন্ধুত্ব বাড়ে। এর একটা আত্মিক মাত্রা আছে।
কিন্তু কখনোই জিজ্ঞেস করোনা কে তোমার প্রকৃত বন্ধু? জিজ্ঞেস কর আমি কি কারো প্রকৃত্ব বন্ধু হয়েছি? সবসময় তোমার নিজেকে নিয়ে বিবেচনা কর। আমরা সবসময় অন্যকে নিয়ে ব্যস্ত। পুরুষ জিজ্ঞেস করে নারীটি তাকে ভালবাসে কি বাসেনা। নারীও ভাবে পুরুষটি তাকে সত্যি ভালবাসে কি না। তুমি কিভাবে অন্যকে নিয়ে নিশ্চিত হতে পার। এটা সম্ভব নয়। সে হয়তো হাজারবার বলবে তোমাকে ভালবাসে, চিরদিনের জন্য তোমাকে ভালবাসে, তবুও একটা সন্দেহ থেকে যায়। কে জানে সে সত্য বললো কি মিথ্যা । যদিও কোনো কিছুকে বার বার বললে আমরা ধরে নিই তা মিথ্যা। কেননা সত্যকে বার বার বলতে হয় না।

হিটলার তার জীবনী গ্রন্থে বলেছে, 'সত্য আর মিথ্যের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য হচ্ছে  মিথ্যেকে বার বার উচ্চারিত করলেই তা সত্য হয়ে যায় যেনো তুমি ভুল যাও তা মিথ্যে' তাই বিশেষজ্ঞরা বলে, বার বার বল, এটা না ভেবেই যে, কে শোনলো আর কে শোনলোনা।

শুরুতে কোকাকলার বিজ্ঞাপনের জন্য বিলবোর্ডে একটি স্থির আলো ব্যবহৃত হত। কোকাকোলা শব্দটিতে আলো জ্বলতো। পরবর্তীতে তারা খেয়াল করলো যদি আলোটা জ্বলে আর নিভে উঠে তাহলে তা আরো বেশি প্রভাব ফেলবে মানুষের মধ্যে। এবং আগে হোক আর পড়ে তা দর্শনকারীর মধ্যে একটা প্রভাব ফেলবে। আর এই পদ্ধতিটাই অবলম্বন করে সকল ধর্ম টিকে আছে। তারা একই মূঢ় বিশ্বাসকে পুনার্বৃত্তি করে চলছে। আর এই বিশ্বাস-ই মানুষের কাছে সত্য হয়ে উঠেছে। মানুষ তার জন্য মরতে প্রস্তুত হয়ে উঠে। কেউ এখনো জানে না স্বর্গ কোথায়। অথচ স্বর্গে যাওয়ার জন্য মরতে প্রস্তুত হয়ে উঠে। 

মুসলীমরা বিশ্বাস করে যদি তুমি ধর্ম যুদ্ধে মৃত্যু বরণ কর তাহলে স্বর্গে যাবে। তাহলে তোমার সব পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হবে । এবং কোটি কোটি মানুষ মারা যাচ্ছে এবং অপরকে হত্যা করছে আর তুমি ধরে নিচ্ছ তা সত্য। 
গত বিশ শতাব্দি ধরে আমরা তাই দেখছি। এডলফ হিটলার বিশ বছর ধরে একটা বিষয় পুণরাবৃত্তি করেছে, সকল সমস্যার মূল ইহুদিরা এবং জার্মানের মত একটি বুদ্ধিবৃত্তিক দেশ তা বিশ্বাস করতে শুরু করলো। সাধারণ মানুষের কথা কি বলা হবে। মার্টিন হাইডেগারের মত একজন বড় দার্শনিকও হিটলারকে সমর্থন করেছে। মার্টিন হাইডেগারের এই বিশ্বাসের পিছনে মূল কারণঃ পূণরাবৃত্তি কর। পুরনরাবৃত্তি করে যাও। 

তুমি এরকম অন্ধ বিশ্বাস আর ধারনা নিয়ে বেঁচে আছ যার কোন ভিত্তি নেই। এবং তুমি যদি এইভাবে বাঁচতে থাকো তুমি তাহলে তোমার অস্তিত্ব অন্ধকার দিয়ে আবৃত হয়ে থাকবে। তোমার একটা ভিত্তিগত পরিবর্তন চাই। তোমার নিজেকে নিয়ে প্রশ্ন কর। অন্যোকে নিয়ে নয়। অন্যের সমন্ধে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না, এবং তার কোনো প্রয়োজন নেই। কিভাবে তুমি অন্যের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারো। এই মুহূর্তে তোমার কাউকে ভাল লাগতে পারে এবং ঠিক পরবর্তী মুহূর্তে তাকে তোমার ভাল নাও লাগতে পারে। এখানে কোনো প্রতিজ্ঞা থাকতে পারে না। তুমি শুধু তোমাকে নিয়ে নিশ্চিত হতে পারো। এবং সেটা একটা নির্দিষ্ট মুহূর্তের জন্য। এবং তোমাকে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই। যা হবার বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্ধারিত হবে। শুধু বর্তমানের জন্য বাঁচো। 

(The way of the Buddha / খন্ডঃ ছয়/ অধ্যায়ঃ ০২)


              -----------------------------------


ফখরুজ্জামান চৌধুরীর অনূদিত একটি অপ্রকাশিত কবিতা


না ফেরার দেশে চলে গেলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক মহাপরিচালক, লেখক, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ফখরুজ্জামান চৌধুরী। গত ১ জুন রাত নয়টায় রাজধানী উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন তিনি দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভোগছিলেন তিনি ফখরুজ্জামান চৌধুরী বিশিষ্ট নাট্যাভিনেত্রী দিলারা জামান চৌধুরীর স্বামী শতাধিক গ্রন্থের লেখক, অনুবাদক এই প্রবীণ সাহিত্যিক সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হন তাঁর মৃত্যুতে সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে তার বড় মেয়ে আমেরিকা এবং ছোটো মেয়ে কানাডায় বসবাস করেন।





প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সাংবাদিক সিনে সাপ্তাহিক চিত্রালীর সম্পাদক আহমদ জামান চৌধুরীর অগ্রজ ছিলেন ফখরুজ্জামান চৌধুরী সাহিত্যিক হিসেবে ষাটের দশক থেকে তিনি বিশ্বসাহিত্যের বহু সাড়া জাগানো গ্রন্থ অনুবাদের পাশাপাশি শিশুসাহিত্য, গল্প, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, রম্য-রচনাসহ নানাবিধ বিষয়ে দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর লেখালেখি করেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার ছাড়াও শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। সাতদিন সম্পাদকের 'শাহবাগ-১' কবিতার অনুবাদের মাধ্যমে তাঁর আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদিত হলো।

Shahbag-1 ][ Saifullah Mahmud Dulal

Today your hairs are ripples of Shahbag
And your feet programme of glory
In your saree's end and shoulder veil
Float the balloon-flags
In your clothes fragrance of Shahbag
In the warmth of hands touch of Shahbag felt
And under the feet dust and clay of Shahbag
Your stethoscope records restlessness of Shahbag
Tune of awakening of the forty fourth
And in your entire body ripples of Shahbag sparkles light.

#
In your richshaw you take me alone to Shahbag
In my Shahbag of dream another Shahbag will emerge

Via Shahbag I will merge with you as I did in Seventy one.


=============

পাওলো কোহেলোর সাক্ষাৎকার
ভাষান্তরঃ অজিত দাশ


[ব্রাজিলিয়ান সাহিত্যিক পাওলো কোহেলো ১৯৪৭ সালে রিও ডি জেনিরো তে জন্মগ্রহন করেন। তিনি লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পূর্বে একজন নাট্যকার,গীতি কবি এবং সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। দ্যা অ্যলকেমিস্ট, দ্যা ভল্ককাইরিস, ভেরোনিকা ডিসাইডস টু ডাই ঐতিহ্যবাহী জাদুবিদ্যার উপর লিখিত তার শক্তিশালী তিনটি বই। দ্যা অ্যালকেমিস্ট এখন পর্যন্ত  সর্বাধিক বিকৃত ব্রাজিলিয়ান বইয়ের তালিকায় রয়েছে যা তাকে বিখ্যাত করে তোলে।]


প্রশ্নঃ আপনার বইয়ের ভিতর দিয়ে কী ধরনের দর্শন মানুষের সামনে তুলে ধরতে চান?
 কোহেলোঃ  আমি যখন বর্তমানের মুখোমুখি হই আমার ভিতরের জিজ্ঞাসা এবং সন্দেহ চড়া হয়ে ওঠে। আমি দেখেছি কোন কিছুর পূর্ণ দর্শন আমাদের ভিতরের প্রয়োজন অনুযায়ি পাল্টাতে থাকে। কিন্তু আমি যদি  আমার কাজের বিশ্লেষণ করি, আমি বলবোঃ নিজ অস্তিত্বের সত্যতা যাচাই কর, তোমার স্বপ্নের মূল্য দাও, কোন কিছুর পূর্ব লক্ষন খেয়াল কর, তোমার নারী স্বত্বাকে জাগ্রত কর এবং তোমার নিজেকে অন্যের চেয়ে আলাদা করে তৈরি করতে সাহস কর ।

প্রশ্নঃ আপনি কিভাবে আপনার বই গুলোকে বিবেচনা  করেন?

কোহেলোঃ  সবগুলো বই এর মধ্যে দুইটা হচ্ছে আমার কল্প কাহিনী   নির্ভর( দ্যা পিলগ্রিমেজ এন্ড দ্যা ভলকাইরিজ)। আর বাকি গুলো আমার জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত- কিন্তু সংকেত এবং রূপকতায় আশ্রিত ভাষা দিয়ে। আমি বিশ্বাস করি কোন শিল্পি বা কোন ব্যাক্তি  তার অভিজ্ঞতা দিয়ে যা  অর্জন করেন তাই অন্যের কাছে প্রকাশ করেন, সেই অভিজ্ঞতাটা কতটুকু রূপকআর কতটুকু বাস্তবসেটা গভীরভাবে চিন্তা না করেই।

প্রশ্নঃ আপনি কখন থেকে লেখালেখি শুরু করেছিলেন?

কোহেলোঃ  কৈশর থেকেই আমি লেখালেখি শুরু করি। তারপর মা আমাকে জানালেন  ব্রাজিলে লেখালেখি করে জীবনধারণ অনেক কষ্টকর। আমি তার কথা বিশ্বাসও করেছি এবং অন্য কিছু করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমি কিছুই করতে পারিনি। তাই আমি কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দেই, একজন হিপ্পি হিসেবে ভ্রমণ করতে শুরু করি । যখন আমি ব্রাজিলে ফিরে এসেছি একটি আন্ডার  গ্রাউন্ড ম্যাগাজিন    প্রতিষ্ঠিত করেছেলাম। আমি তখন গীতি কবিতা লেখার জন্য প্রস্তাব পেয়েছি এবং পরবর্তীতে সাংবাদিকতাও করেছি। লেখালেখি ছাড়াই আমি জীবনযাত্রা শুরু করেছিলাম। যদিও  আটত্রিশ বছরের আগে আমি কোন বই লেখা শুরু করিনি।

প্রশ্নঃ কেন?

কোহেলোঃ   আমি বিশ্বাস করি দুটি জিনিস মানুষকে স্বপ্নের কাছ থেকে দূরে রাখেঃ এইটা ভাবতে শুরু করা যে এটা একেবারে অসম্ভব, এবং এইটা উপলব্ধি করা যে এইটা সম্ভব (দ্বিতীয় ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে একটা ভীতি কাজ করে যদি সে জীবনের আসল মানে হারিয়ে ফেলে)

প্রশ্নঃ আপনাকে কোন কোন জিনিস অনুপ্রাণিত করেছে?

কোহেলোঃ  আমার ঘুরে দাড়ানোর মুহূর্তটি হচ্ছে সান্তিয়াগো দে কম্পোসতিলারউদ্দেশ্যে তীর্থভ্রমণে বেড় হওয়া। আর তারপরই আমি আমার জীবনের বেশির ভাগ সময়তে প্রকৃতির গোপন রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য নিয়োজিত করেছি, আর উপলব্ধি করেছি সেখানে কোন গোপনীয়তা নেই। আমাদের অবশ্যই কোন কিছুর পূর্ব লক্ষনকে জানা দরকার এবং অন্যের প্রতি মনোযোগ তৈরি করা দরকার। জীবন একটা অপরিবর্তনীয় অলৌকিক ঘটনা এবং এই অলৌকিকতা অন্যকে বিপদের মুখোমুখি ফেলে নিজেই স্পষ্টতর হতে থাকে। এই তীর্থযাত্রার পর আমি আমার আধ্যাতিক অনুসন্ধানকে অনেক বেশি পরিমাণে বোঝার চেষ্টা করেছি এবং এখনো  অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে যাচ্ছি।

প্রশ্নঃ আপনার দ্যা ভলকাইরিস বইটিতে আপনি নিজেই নায়ক। বইটি কি আপনার আত্মজীবনীমূলক?

কোহেলোঃ  হ্যা এটা আত্মজীবনীমূলক, এবং এখানে যা বর্ণনা করা আছে সব সত্য। উপরের  প্রশ্নগুলোকে পরিপূর্ন ভাবে পেতে এবং আরো সহজ সাধ্য করতে আমি একজন অভিভাবক দেবদূতকে খোজেছি এবং এখনো আমি মনে করি নির্মলতাই ঈশ্বরের কাছে পৌছানোর সবচেয়ে ভাল পথ।

প্রশ্নঃ আপনি কি কখনো দেবদূত দেখেছেন?

কোহেলোঃ  হ্যা আমি দেখেছি। তারা কি তা সবাই জানে Ñ তারা ঈশ্বরের বার্তা বাহক। স্বর্গীয় আলোর দ্যুতি। কিন্তু তারা আমাদের সাথে অন্যের মাধ্যম হয়ে অস্বভাবিক ভাবে কথা বলে।

প্রশ্নঃ ভলকাইরিস বইটিতে আপনি নিজেকে জাদুকর বলেছেন। আসলে তাই কি? সত্যি কি আপনি একজন জাদুকর?

কোহেলোঃ  প্রতিটি মানুষই জাদুকর- সান্তিয়াগো দে কম্পোসতিলারপথে এটাও আমার জন্য একটা বড় শিক্ষা। বিষয়টা হচ্ছেঃ কেহই এটা গ্রহণ করেনা যে, তার মধ্যে একটা সহজাত গুন এবং ক্ষমতা রয়েছে। জাদুর মধ্যে দুইটি ঐতিহ্য আছেঃ একটি চাঁদ আরেকটি সূর্য। প্রথম ব্যাপার হচ্ছে জ্ঞানকে সংবদ্ধ করা আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে তার উন্মোচন ঘটানো। আমার যৌবনে আমি সনাতন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান করেছি, এখনো আমি উপলব্ধি করি যে- আমি এবং আমরা প্রত্যেকে সবকিছুই জানি। জগতের মূল স্রোতের সাথে আমাদের একাত্ম হতে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান  হচ্ছে শুধুমাত্র আমাদের ইচ্ছার একটা উপায়।

প্র্শ্নঃ আপনি লিখেছেন যে জাদুমন্ত্রকে আপনি শখ হিসেবে চর্চা করেন। এর মধ্যে দিয়ে আপনি আসলে কি খুজে পান?

কোহেলোঃ  এটা ভলকাইরিস বইটিতে লেখা আছে। কোন রকমের দায়িত্ব না নিয়েই, আমি আসলে এমন একটা শক্তির সাথে আবদ্ধ হয়েছিলাম যার সাথে আমার কোন পূর্ব পরিচিতি ছিলনা। কিন্তু ঈশ্বর দয়ালু যে আমাকে একটা কঠিন শিক্ষা দিয়েছেন।

প্র্রশ্নঃ কার্লোস কাস্টানিডাও জাদুবিদ্যার উপর একটি বই লিখেছিলেন। আপনাদের দুইজনের ধারণার মধ্যে কি কোন সাদৃশ্য আছে?

কোহেলোঃ  কাস্টানিডাআমার যৌবনে অনেক ভূমিকা রেখেছে। আমি স্পষ্ট ভাবে জানি, বিশ্বাসের ভিতর দিয়েই কেহ শ্বাশত জ্ঞান অর্জনের পথে যেতে পারে।

প্রশ্নঃ আপনার জীবনের মূল চালিকা শক্তি কী?

কোহেলোঃ প্রতিটি মানুষের জীবনে একটি উদ্দেশ্য আছে।  এইটা আমরা তখনি জানতে পারি যখন আমরা হ্নদয়ের কথা শুনে লক্ষ্যের নিকটবর্তী হই। তাই আমার চালিকা শক্তি হচ্ছে আমার উদ্দেশ্যকে  পরিপূর্ণ করা।

প্রশ্নঃ একজন লেখক কি লেখালেখির জন্যই জন্ম গ্রহণ করেন বা তিনিকি দিব্য আশীর্বাদপ্রাপ্ত?

কোহেলোঃ তোমার প্রযয়োজন অনুপ্রেরণা, দৃঢ়তা এবং ক্ষমাশীলতা। তোমার একটি পরিষ্কার লক্ষ্য থাকা দরকার, কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর জন্য তোমার নিজেকে সেই ভাবে পথপ্রদর্শক হতে হবে।

প্রশ্নঃ আজকাল অনেকেই মনস্তাত্বিক চিকিৎসার কথা ভাবেন, কেউ কেউ সমাধি বা কোন নির্দিষ্ট পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে চায়। আপনার কি মনে হয় মানব জাতির পরিবর্তনে এগুলো কোন সঠিক নির্দেশনা?

কোহেলোঃ  আমি দেখতে পাচ্ছি যে, মানুষ ঈশ্বরের সাথে তাদের যোগাযোগটিকে জটিল করে তুলছে। যদিও এই নতুন ধারণা একটা নির্দিষ্ট দৃঢ়তার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে। কিন্তু এইটাকে সবকিছু ভেবে আমরা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিতে পারিনা। এপেনডিসাইটিসের জন্য মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসক নয় বরং একজন শল্যচিকিৎসকের প্রয়োজন।

প্রশ্নঃ কোন জায়গাটি থেকে আমরা সমাজ বিকাশের পথ সূচনা করবো?

কোহেলোঃ  আমরা দুইটি জায়গার মধ্যস্থলে অবস্থান করছি। ইতিমধ্যেই  আধ্যাত্মবাদ পরবর্তীর প্রজন্মের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করছে। আমাদের হাতে দুইটি সম্ভাবনা আছেঃ হয়ত আমাদেরকে মৌলবাদি হতে হবে নইলে সহনশীলতার দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আমি সহনশীলতার কথাই বলবো কিন্তু এটা একটা দীর্ঘ সংগ্রাম এবং এটা নির্ভর করবে বর্তমানে মানুষজন ঘটনা পরম্পরায় কিভাবে আচরণ করে তার উপর।

প্রশ্নঃ দ্যা অ্যালকেমিষ্টআপনার বইগুলো থেকে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছে। আপনি কি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন এইটা আপনার সবচেয়ে ভাল বই?

কোহেলোঃ  আমি আমার সবগুলো বইকে এ প্লাস দিব, কেননা এই বইগুলোর ভিতর আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠটাকে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। তার মানে আমার বইগুলু আমার নিজের চেয়ে অধিকতর ভাল।

প্রশ্নঃ আপনি কি কোন লেখক দারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন?

কোহেলোঃ   হ্যা, কাস্টানিডা, হেনরি মিলার, উইলিয়াম ব্ল্যাক। কিন্তু সবার উর্ধ্বে জর্জ আমাডো এবং জর্জ লুইস বোর্হেস।

প্রশ্নঃ একজন লেখক সমাজে কি রকম ভূমিকা পালন করেন?

কোহেলোঃ একজন মালী বা টেক্সি চালকের মতই ভূমিকা পালন করেঃ যদি তুমি প্রবল উৎসাহ আর ভালবাসা নিয়ে কাজ কর তাহলে মানুষ ভালোর দিকে প্রভাবিত হবে।  


প্রশ্ন:  কোন জিনিসটা আপনাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তুলেছে?

কোহেলোঃ  আমি অন্যের বইকে বিচার করতে চাই না। আমার বইগুলো কেবল আমার অভিজ্ঞতাকে চিত্রিত করেছে, আমার প্রজ্ঞাকে নয়। প্রথমত আমি জ্ঞানী নই- যা আমি আগেও বলেছি, সবাই সব কিছু জানে আবার কেহই কিছু জানে না কেননা ঈশ্বর গনতান্ত্রিক। দ্বিতীয়ত, অভিজ্ঞতাই হচ্ছে সব যা তুমি অবশ্যই অন্যকে জানাবে। এটাই আমাদের বিচারঃ অন্যকে জানানো। একটি বই মানুষের মধ্যে পরিবর্তন এনে দিতে সাহায্য করে, মানুষকে বোঝাতে সাহায্য করে যে সে একা নয়। অনেক লেখকরাই আমাকে এইটা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন এবং আমি আমার জীবনে অনেক অস্থির মুহূর্তে স্বস্থি পেয়েছি। একটি বই ভাল তোমার ভাল সঙ্গী হতে পারে। কিন্তু তা নির্ভর করে আমাদের ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার উপর।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন