ভ্রমণ


আরব ভ্রমণ এবং আমাদের বাঙালিরা
ড. মাহফুজ পারভেজ

সুবেহ সাদেকে জেদ্দা বিমানবন্দরে নেমেই লোহিত সাগরের শৈত্য সম্ভাষণের মুখোমুখি হতে হলো। সূর্য তখনও ওঠেনি এবং শেষ আগস্টের আসি-আসি  কুয়াশাও বেশ জমাট। বিপুল বিশাল বিমানবন্দরের চারদিকে স্তব্ধ আলোর বন্যা। বাসে করে প্রায় পনেরো মিনিট। অনেক রানওয়ে এড়িয়ে বাস এসে দাঁড়াল টার্মিনালেযাকে দানবীয় ইমারত বলাই সঙ্গত।

ভেতরে রাজ্যের পণ্য নিয়ে অসংখ্য দোকান। সৌদি মুঠোফোনের সিম সংগ্রহ করতে মোবাইলি’ কোম্পানির কাউন্টারে দাঁড়াই। দেখলামবাংলাদেশের বিমানযাত্রীরা এসে পৌঁছতেই নতুন দুজন কর্মচারী সামনে এসে হাজির। আগের কর্মচারীদ্বয় ততক্ষণে দোকানের অভ্যন্তরে। লোক বদলের রহস্যও টের পাওয়া গেলÑ সেলসম্যান দু’জনই বাংলাদেশি। আমার সামনের জন জাভেদ হোসেনচট্টগ্রামের হালিশহরের তরুণ। ব্যবসার সুবিধার্থে কত কিছুই করা হয়।
মক্কাতেও বাংলা ভাষা অশ্রুত নয়। দোকানপাট সবই বাংলাদেশের লোকজনের। হিলটন হোটেলমক্কা টাওয়ারে অভিজাত বিপণিবিতানেও বাংলাদেশি সেলসম্যান রয়েছে। কেএফসি বা মেভেনপোক আইসক্রিমও বেঁচে বাংলাদেশের তরুণ। দাল্লা’ নামের যে কোম্পানি নগর পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব পালন করছেতার ৮০ ভাগ শ্রমিক বাংলাভাষী। তবে এরা বাঙালি নয়বেশির ভাগই মিয়ানমার-আরাকানের রোহিঙ্গা।

বায়তুল্লাহ বা কাবাগৃহের বিশাল মসজিদ প্রাঙ্গণের চারদিকে মেসফালাজিয়াদসামিয়াগাজ্জা প্রভৃতি এলাকা। মেসফালার অর্থ নীচু এলাকাএই মেসফালাকে বলা যায় বাংলাদেশের ক্ষুদ্র সংস্করণ। মহানবী (সা.) যে পথে হিজরত করেছিলেনসে পথের বর্তমান নাম হুজরা রোড। কাবা প্রাঙ্গণ থেকে হুজরা রোড গিয়ে ইবরাহিম খলিলর রোড হয়ে  মিশেছে মক্কা সার্কুলার রোড নামে খ্যাত ওমর আল খাত্তাব (রা.) সড়কে। এই হুজরা রোডের দুপাশেরই নাম মেসফালাÑ সেখানে দাখালাআবু তামাঞ্জাসবজিমণ্ডিসহ আরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মহল্লা রয়েছে। মেসফালার প্রধান কেন্দ্র ঢাকা হোটেলচট্টগ্রাম হোটেলকে ঘিরে। আশপাশে বাংলা ভাষায় সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে শত শত দোকান। হোটেলচা-খানালাইব্রেরিবুক স্টলমুদিখানা থেকে শুরু করে লন্ড্রি এবং সেলুন পর্যন্ত। বিকালে বা সন্ধ্যায় এই চত্বরে দাঁড়ালে মনে হয় ঢাকার শাহবাগচট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা বা সিলেটের জিন্দাবাজারে রয়েছি। বাংলাদেশের তাবৎ পণ্য-সামগ্রীর মতো তাজা খবরও বাতাসে ভাসে। আওয়ামী লীগবিএনপির নানা বিষয় এখানে নিত্য আলোচিত হয়। তথ্যপ্রযুক্তির সুবাদে বাংলাদেশের চ্যানেলের খবর তো বটেইমোবাইলের বরাতে অতিরিক্ত খবরও মেলে।

আরবদের  ঐতিহ্যবাহী ইফতারি
মেসফালার পাশেই নাক্কাসা এলাকা- মক্কার বাঙালিপাড়া। বাঙালিপাড়া হলেও অধিবাসীরা মূলত মিয়ানমার আরাকানের রোহিঙ্গা।  প্রমিত বাংলায় কথাও বলতে পারেন না। চট্টগ্রামের যে আঞ্চলিক-কথ্য ভাষা তারা ব্যবহার করেনসেটা চাটগাঁইয়াদের কাছেও দুর্বোধ্য। নাক্কাসার শাপলা হোটেলে বাংলাদেশি খাবার খাওয়া হলো। আশপাশে আরও অনেক হোটেল। রান্নার ব্যবস্থা আর আসনবিন্যাসে মনে হলো একেকটি হোটেল যেন শাহবাগের মৌলিসিলভানা বা নীলক্ষেতের বিউটি।
মক্কায় অনেক বছর বসবাস চট্টগ্রামের আবুল কাশেমলক্ষ্মীপুরের হাবিবুল্লাহর। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন কুমিল্লার মাসুমকিশোরগঞ্জের মুসা। সবার মধ্যেই চাপা আতঙ্ক- বিদেশিদের জন্য সৌদি সরকারের নীতিতে অনেক কড়াকড়ি দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ বা স্বাধীনতা-পূর্ব কাল থেকে পাকিস্তানের পাসপোর্ট নিয়ে ৪০/৫০ বছর ধরে যে রোহিঙ্গারা সৌদি আরবে বসবাস করে সে দেশের সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে প্রায় মিশে গেছেআরবি আলখাল্লা গায়ে দিয়ে আরবিতে বাতচিত করছেতারাও ভয়ে রয়েছে। কবে জানি দেশ ছাড়তে হয়- এমন ভয়ের কারণও কাল্পনিক নয়। সৌদি আরবে বিদেশিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধান নেই। সৌদিতে বিদেশি মানে বিদেশিইআজনবি। সে কখনও সৌদি বা আরব হয়ে জমিজমা কিনে স্থানীয় লোকদের মতো সুবিধা পাবে না। বাইরের লোকজন মূলত কোনও সৌদির প্রযতেœ থেকে ব্যবসা বা চাকরি করে। এ জন্য বিদেশিকে যে অনুমতি বা পারমিট নিতে হয়তার নাম আকামা। বছরের পর বছর সৌদি মালিক বা কফিলকে মোটা টাকা দিয়ে আকামা রিনিউ করেই বিদেশিরা একটানা দীর্ঘদিন বসবাস করেছেব্যবসা চালিয়েছেএমনকি বউ-বাচ্চা নিয়ে বাস করছে। সৌদিতে চাকরির সুযোগ কমে যাওয়ায় আকামা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও অনেক কমে এসেছে। প্রায় পনের-বিশ লাখ বিদেশি যে বছরের পর বছর নাগরিক না হয়েও সৌদিতে থেকে যাচ্ছেসেটাও সম্ভবত কর্তৃপক্ষের নজরে এসেছে। এই বিপুল সংখ্যক বিদেশির মধ্যে নাকি পাঁচ লাখই রোহিঙ্গাযারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে সৌদিতে রয়েছে।

আজিজিয়া এলাকাটি হলো মক্কার গুলশান আর রোসাইফা হলো ধানমন্ডি। তারকাচিহ্নিত হোটেলঅভিজাত বিপণিহোটেলরেস্তোরাঁয় ঝাঁ-চকচকে সাজানো আয়োজন। সেখানেও বাংলাদেশি! ময়মনসিংহের নান্দাইলের জুয়েল কাজ করে ওয়েটারের। তার কন্ট্রাক্টের চাকরিমেয়াদ পাঁচ বছর। দেশে ফেরত যাওয়ার ভয় আপাতত জুয়েল এবং তার মতো চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীদের বেলায় বেশি কার্যকর নয়। মক্কার সবচেয়ে অভিজাত আবাসিক এলাকার নাম আওয়ালিআমাদের বারিধারার সঙ্গে তুল্য। দেখার মতো বাড়িঘরস্থাপত্য ডিজাইন ও নগর পরিকল্পনা। আমাদের সঙ্গে ছিলেন কানাডার ভ্যাঙ্কুভার প্রবাসী ফরিদা ইয়াসমিন বেবি। আওয়ালি দেখে অবাক হলেন। বললেনআমেরিকা তথা বিশ্বের সবচেয়ে বিলাসবহুল এলাকা বেভারলি হিলের আভিজাত্যের পাশে আওয়ালিকে স্থান দিতেই হবে।

আরবে নান্দনিক (মূর্তি নয়) স্থাপিত্যশিল্প।
মক্কা থেকে মদিনা প্রায় ৬শ কিলোমিটার। কালো পাথরের গ্রানিট পাহাড়ের শীর্ষ দিয়ে পথ। যেদিকে চোখ যায় কেবল প্রান্তরপাহাড় ও পাথর। সবুজের সামান্য নিশানাও নেই। চোখে কোনও লোকালয়ও দেখা যায় না। এই পথের এক শ কিলোমিটার পর পর পরিকল্পিত বিশ্রামস্থলযেখানে পেট্রোল পাম্প আর স্ন্যাকসবার। পেট্রোল পাম্পের কথা আসায় তেলের দেশে তেলের দামটিও বলে রাখি। রিয়ালে তিন লিটার। বাংলাদেশের হিসাবে ৬ টাকায় এক লিটার। যে দেশে এক রিয়ালে এক লিটারের পানির বোতল পাওয়া যায়সে দেশেই এক রিয়ালে তিন লিটার তেল (পেট্রোল) পাওয়া যায়। অর্থাৎ পানির চেয়ে তেলের দাম বাস্তবেই কম। তবে সুযোগ পাইনি বলে তেল আর ঘি-এর দামের তুলনা করা সম্ভব হয়নি। সেই বিরান মরু পথের পেট্রোল পাম্পঘেঁষা চা-নাশতার দোকানেও পাওয়া গেল বাঙালির দেখা। বগুড়ার জনি চা পরিবেশন করল আমাদের। হায়! দেশে যে বাঙালি অলস বলে প্রসিদ্ধবিদেশে তার কী কঠোর কর্মসাধনা! অথচ দেশে এই জনি এবং জনির বয়েসী ছেলেরা কাজ খুঁজে পায় না!

আরবে নান্দনিক (মূর্তি নয়) স্থাপিত্যশিল্প।
মক্কার মতো মদিনাতেও বাঙালিপাড়া আছে- জায়গাটির নাম হাইয়াল মাসানি। চীনা বা ইহুদিপাড়া যেমন একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য পেয়ে গেছে, বাঙালিপাড়াও তেমনি একটি আন্তর্জাতিক চারিত্র্য পেয়ে যাচ্ছে। মক্কা বা মদিনার সাজানো আয়োজনের মধ্যে কিছুটা অগোছাল, হট্টগোলপূর্ণ এবং অবশ্যই নোংরা জায়গা দেখলে আশপাশে বাঙালি হোটেল আর দোকানের দেখা পাওয়া যাবে। গোপনে ডলার-রিয়াল ভাঙানো, দেশি গালগল্প আর গুজব বাঙালিপাড়ার মূল লক্ষণ। মক্কা-মদিনায় প্রকাশ্যে মদ, নেশা তো দূর অস্ত, সিগারেটও কেনাবেচা হয় না। ব্ল্যাকে সিগারেট কেনার গোপন স্থানটিও বাঙালিপাড়াতেই অবস্থিত। এর বাইরে পান, সুপারি, শুঁটকি-মাছসহ বিকাচ্ছে হাজারো বাংলাদেশি পণ্য। তবে কেনাকাটার ক্ষেত্রে বাঙালি দোকানে বাড়তি খাতির পাওয়ার আশা মিছে- দাম আকাশচুম্বী। সৌদি হিসাবে এক রিয়ালে এক কাপ চা পান করা বিশেষ খরচ নয়, আমাদের জন্য কিন্তু পকেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে প্রায় কুড়ি টাকা। ফলে সৌদি বাজারে যা সস্তা, আমাদের জন্য সেটাই মহার্ঘ্য। তবে স্বর্ণের ব্যাপারে সৌদি বাজারে বাংলাদেশিদের জন্য সুবিধা রয়েছে। সেখানে স্বর্ণের ভরি পয়তাল্লিশ হাজার টাকা, বাংলাদেশে ষাট হাজারের কাছাকাছি। দেখার মতো জায়গা বটে স্বর্ণের দোকান! আলোর বন্যায় এক-একটি দোকান বিপুল সামগ্রী নিয়ে পসরা সাজিয়েছে। 
আরবে নান্দনিক (মূর্তি নয়) স্থাপিত্যশিল্প
জেদ্দার স্বর্ণের মার্কেট  দেখেছিসেটা বিশ্বের অন্যতম প্রধান সোনার বাজার। আর আছে বাহারি পাথর- আকিক, নীলা, রুবি, পান্না, পোখরাজ, গোমেদ, চুনি, মুক্তা, হীরা- কী নেই। বড় বা ছোট, যে আকারেরই পাথর দরকার, ভোক্তাকে দেওয়ার জন্য মজুদ আছে। কোনও কোনওটির দাম দেড়-দুই হাজার সৌদি রিয়াল, যারা পাকা জহুরি, জহরত চেনেন, তারা দামের দিকে না তাকিয়েই দেদার কিনছে সেসব।
বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে সৌদি ব্যবস্থাপনা অতুলনীয়। দাম এবং পণ্যের সরবরাহ সব সময় একদম স্থিতিশীল। সাধারণ সময়ে যে দাম এবং যত সুলভ, হজের প্রায় এক কোটি মানুষের ভিড়ের সময়ও একই অবস্থা। বাজারের বড় দোকানে যে দাম, গলির মুদি দোকানে একই দাম। কোনও দ্রব্য শেষ হওয়ার আধ ঘণ্টার মধ্যে সাপ্লাই, পিকআপে মালপত্র হাজির। মেয়াদোত্তীর্ণ কোনও খাদ্যদ্রব্য সৌদি আরবের দোকানগুলোতে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। উৎপাদনকারী কোম্পানি নিজ দায়িত্বে সেগুলো সরিয়ে নিয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে বাইরে খাওয়ার জন্য সৌদি আরব আদর্শ।

==============
কলকাতা: প্রথম দেখা প্রথম ছোঁয়া
শাকুর মজিদ


কলকাতাকে আমি প্রথম দেখি ১৯৯০ তে। আমার তখন পঁচিশ, কলকাতার তিনশ। ইংরেজ আমলে খোদ ভারত বর্ষের রাজধানী থাকা এই শহরটি সে বছর তার তিনশবছর পূর্তি করেছিল বলে বেশ বড় আন্তর্জাতিক স্থাপত্য সম্মেলনের আয়োজন করেছিল এই শহরের প্রশাসন। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস আর তার ওয়েস্ট বেঙ্গল চ্যাপ্টার তার আয়োজক। ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেকক্ট বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদের ছাত্র-শিক্ষক মিলে যে টিম হয়েছিল, তার কনিষ্ঠতম সদস্য হিসেবে আমারও তখন অন্তর্ভুক্তি ছিলো। সে আরো প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। আমি তখন থার্ড ইয়ারে পড়ি।
১৯৯০ থেকে ২০১৪, এ সময়ের মধ্যে গড়ে অন্তত: বছরে একবার যাওয়া হয়েছে কলকাতায়। দেশের বাইরে একক কোনো শহর হিসেবে এই কলকাতাতেই আমার সবচেয়ে বেশি যাওয়া। কলকাতাকে তাই আমার বিদেশী শহরও মনে হয় না, আবার নিজের শহরও না। তারপরও এক ধরনের ভালোলাগ থেকেই আমি সুযোগ পেলেই কলকাতা ঘুরে আসি।
পঁচিশ বছর আগে পঞ্চাশ ডলার সঙ্গে নিয়ে ৭ দিন আরামছে ঘুরে বেড়িয়েচার-পাঁচশো টাকার বাজার করে ফেরত এসেছিলাম মহানন্দে। যশোর থেকে বেনাপোলবেনাপোল ছেড়ে যখন হরিদাসপুর এসে পড়িশুনি ইন্ডিয়া এসে গেছি। কিন্তু কোথায় ইন্ডিয়াদেখি এ তো বাংলাদেশেরই মতো সব কিছু। সে রকম মাটিরাস্তাগাছপালাঘরবাড়ি। প্রথম যে তফাতটুকু চোখে এলোতা ঘরের চাল। আমরা টিন ব্যবহার করিওখানে মাটির টালি। যশোর রোডের উপর দিয়ে আমাদের ভ্যানগাড়ি ছুটে চলে। আমরা মালামাল নিয়ে ভ্যানের উপর। দুপাশে বড় বড় গাছ। গাছের ছায়া পড়েছে ভাঙাচোরা পুরনো পিচঢালা পথের উপর। খানিক চলার পর এসে নামি বাসস্ট্যান্ডে। সেখান থেকে এসে নামি নিউমার্কেটের কাছে।
দলের কনিষ্ঠ সদস্যদের দায়দায়িত্ব সবখানেই অনেক কম থাকে। আমরাও কাজছিলো ডিপার্টমেন্টের বড় ভাইদের শুধু অনুসরণ করা। বাংলাদেশ থেকে ৫০ সদস্যের যে টিম এসেছিল তার মধ্যে ৩৫ জনই ছাত্র। বাকীরা শিক্ষক ও স্থপতি। তাঁদের অনেকের বক্তৃতা আছে সামাবেশে। আমাদের কাজ অডিটরিয়ামের আসন ভর্তি করে রাখা আর বক্তৃতা শোনা।
বড় ভাইদের অনুসরণ করে করে আমি যে সড়ক দিয়ে আমার ব্যাগ কাঁধে হাঁটতে থাকি তার নামটা ইংরেজিতে লেখা Sudder Street আমি ভালো করে নামটা পড়তে চাই সুদ্দার স্ট্রিট! এক জায়গায় দেখি, বাংলায় লেখা আছে সদর স্ট্রিটসদরকে কেনো তবে ওমন বিদঘুটে ইংরেজিতে লেখা হবে!


জগলুল ভাই আমাদের সঙ্গী। সিনিয়র মোস্ট ক্লাসের ভাই। তিনি প্রায় ধমক দেন আমাকে। বলেন- চুপ থাক। ওটা ইংরেজদের ঠিক করা নাম। ওরা যার নাম যেভাবে ইচ্ছা লিখেছিল- সেই নামে পরে বাঙালীরাও তাদেরকে এই নামে ডেকেছে। ইংরেজরা চলে গেছে ঠিক, কিন্তু তাদের ভুল উচ্চারণে ডাকাটা অনেক বাঙালীর কাছে ফ্যাশনের মতো ছিলো। এখনো আছে।
কলকাতার সদর স্ট্রিট দেখা দিয়েই শুরু হয়েছিল কলকাতার আমার প্রথম প্রভাত। ডরমেটরি লজ টাইপেরর সস্তার হোটেল মারিয়াতে জন প্রতি কুড়ি টাকায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। এক কামরায় ৮ জন। বাহ! সে বড়ই মজার স্মৃতি।
সদর স্ট্রিট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা কলকাতা যাদুঘরের কাছে যেতাম। সেখান থেকে বাস নিয়ে যেতো পাঁচতারা হোটেল তাজ বেঙ্গলএ। দিনভর আলীশান হোটেলে বক্তৃতা শোনা আর রাজকীয় ভোজভাজ! বাহ! তখন তো আমরা ছাত্র। পাঁচতারা হোটেল কি, সেটাই বা কী জানি! কিন্তু সেইতো প্রথম! প্রথম কলকাতা, প্রথম পাঁচতারা হোটেলের ঘ্রাণ।
শুধু কী হোটেলটি? শহরটি কী নয়? আমরা ট্রামে চড়ি, বাসে চড়ি, টাঙায় চড়ি। ডামে বামে ভিক্টোরিয়ানরীতির বিশাল দালানকোটা। এ রকম কিছু দালান আমাদের ঢাকাতেও আছে। হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট, কার্জন হল, ঢাকা মেডিক্যালের কিছু অংশ, আরো দুএক জায়গায়। কিন্তু কলকাতায় দেখি এই পার্ক স্ট্রিট-চৌরঙ্গী আর ডালহাউসিতে-এসব বিশালাকার দালানের ছড়াছড়ি।
কলাকাতা আমাকে প্রথাম কে চিনিয়েছিল তা খুব ভালো করে বলতে পারবো না। দেশ পত্রিকার কল্যাণে কলকাতাকে প্রথম জানি আমি। আরেকটু গুছিয়ে বললে, সুনীল আর শংকরের উপন্যাস আমাকে কলকাতা চেনায়।
আঁশির দশকে আমি আউট বইয়ের পাঠক হই্ প্রথম যে কটা বই পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম সেগুলো ছিলো শংকর এর লেখা। কত অজানারে’, ‘যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ’, ‘চৌরঙ্গী’- এগুলোর কথা মনে ছিলো। শংকর এর কাছ থেকেই আমার চৌরঙ্গীনামটি জানা। কলকাতার প্রথমবার এসে দেখি, সেই চৌরঙ্গী। সেই গ্রান্ড হোটেল। এই গ্রান্ড হোটেলে কাজ করতেন শংকর। জনসংযোগ বিভাগে। এই হোটেলের কত অভিজ্ঞতা তিনি লিখেছেন সেই বইগুলোতে। কলকাতা এসে আমি এইসব লেখকদের দেখার জন্য অস্থির হয়ে যাই।
দ্বিতীয় দিনের সেমিনার চলছে তাজ হোটেলের বলরুমে। সেখান থেকে কায়দা করে একটা ফোন করার ব্যবস্থা হয়ে যায় আমার। কায়দাবলছি এ কারণে যে, ঐ ইভেন্ট কভার করতে আসা এক ফটোজার্নালিস্ট আমাকে খাতির করেণ। তিনি আনন্দবাজারগ্রুপের ফটোজার্নালিস্ট। টেলিগ্রাফের হয়ে ছবি তুলতে এসেছেন এখানে। সেমিনারে আসা আর্কিটেকটরা কেউ তাকে তেমন পাত্তা দেয় না। আমি দেই। পাশে গিয়ে বসে গায়ে পড়ে কথা বলি। আমার সঙ্গে দশ মিনিটের মাথায় তার ভাব হয়ে যায়। ভাবের কারণ আমার ক্যামেরা। তিনি যে মডেলের ক্যামেরা ব্যবহার করছেন, আমারটাও তাই। তাঁর প্রথমে ধারণা হয়েছিল- সম্ভবত: বাংলাদেশ দলের অফিসিয়াল ফটোগ্রাফার হিসেবে আমি এসেছি এখানে। আসলে সেটা যখন নয়, এবং আমি যখন স্থাপত্যের ছাত্র, আবার সম্মেলনের ডেলিগেট, আমাকে কিঞ্চিৎ খাতির করেন তিনি এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় কী করে কাউকে ফোনে পেতে হয় বর্ণনা করে, ব্যবস্থা করে দেন।
দি ডেইলি টেলিগ্রাফের ফটোজানালিস্ট আমার পাশে দাড়ানো। হোটেল রিসেপশনের পাশে থাকা ইন্টারকম ফোন থেকে আমি অপারেটরকে বলি, আমাকে যেনো আনন্দবাজারে ফোন করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়।
ফটোজার্নালিস্ট আমাকে জিগ্যেস করেন-সুনীলদার সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে তো?
আমি জবাব দেই না। আমার ফোন কানে লাগানো। আমি অপেক্ষা করি অপারেটরের কথা শুনতে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার কী হন? আত্মীয়? আত্মীয়তো বটেই। আত্মীয় না হোক- পরিচিততো বলতেই হবে। বিশ্বাস না করলে আমার ভিসা ফরম দেখে নিতে পারে যে কেউ। আল্লাহ না করুক, এই কোলকাতায় এসে যদি আমার কিছু হয়ে যায়, কেউ যদি আমার কোনো খোঁজ না পায়, যদি একজন মাত্র মানুষের কাছে আমার খোঁজ নেয়ার অধিকার থাকে ভারত সরকারের, তিনি হলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
ঘটনাটা ঘটে ভারত দূতাবাস অফিসে। পাসপোর্ট নিয়ে গিয়েছি, ছবি নিয়েছি, পাসপোর্টে ডলারের এনডোসমেন্ট করিয়েছি ৫০ টাকা খরচ করে। ধানমন্ডির দুই নম্বর সড়কের এই অফিসে অনেক দালাল আছে। একশো টাকা দিলে সব করে দেয়। পরদিন ভিসা। একশো টাকা খরচ না করতে চাইলে নিজে লাইনে দাঁড়াও, ফরম কেনো, ফিলাপ করে জমা দাও। রশিদ নাও, আবার কাল এসে লাইন ধরে রসিদ দেখিয়ে পাসপোর্ট ভিসা ফেরত নাও।
একশো টাকার অনেক দাম আমার কাছে। আমি নিজে ফরম ফিলাপ করতে গিয়ে দেখি, কোলকাতার কোনো পরিচিত লোকের ঠিকানা নাম ঠিকানা দিতে হবে।
আমি তিন সেকে- চিন্তা করলাম। যে কনফারেন্সে যাচ্ছি, তার ঠিকানা সবাই দিয়েছে। কিন্তু আমি তো সেসব নিয়ে আসিনি। এখন কী করা?
আমি চিনি শংকর আর সুনীলকে। শংকরের ঠিকানা জানি না। সুনীলেরটা জান্ িআনন্দবাজারের ঠিকানা আমার মুখস্থ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম লিখে দেশ পত্রিকার ঠিকানা বসিয়ে দেই আমি। আমার ভিসা হয়ে যায়।
এবার মনে ভাবলাম, যাঁর নাম বিক্রি করে ভিসা নিয়েছি, তার সঙ্গে একটু কথাই না হয় বলি, দেখা করি। দেখা না করুক, যেতে তো আর সমস্যা নাই!
আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন আনন্দবাজার গ্রুপের ফটোজার্নালিস্ট। আমি ইন্টারকম কানে লাগিয়ে অপেক্ষা করছি টেলিফোন অপারেটরের। মিনিট দুয়েক আমাকে অপেক্ষায় রেখে এক সময় অপারেটর জানায়- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আজ অফিসে আসেননি। আমি সঙ্গে সঙ্গে বলি- তাহলে শীর্ষেন্দুকে দেখেন।
ওপাশে ফোন ধরেছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। এপাশে আমি, পঁচিশের শাকুর মজিদ।
হ্যালো, নমস্কার
নমস্কার দাদা, আমি কী শীষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলছি’?
জ্বী। বলুন।
দাদা আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি, আর্কিটেকচারের স্টুডেন্ট। আপনার লেখা পড়েছি। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।
কখন আসতে চান?’
আপনি বললে এখনই রওয়ানা দিতে পারি।
এখন ঠিক কোথায় আছেন আপনি?’
তাজ বেঙ্গল
এরপর তাজ বেঙ্গল থেকে কী করে কোন বাস/ট্রাম ধরে আনন্দবাজারে আসতে হবে, বাস থেকে নেমে কতটুকু হাঁটতে হবে, গেটে কী কথা বলতে হবে, তিনি আমাকে বুঝিয়ে দেন।
আমি বলি- দাদা, আমি ট্যাক্সি নিয়ে আসছি।
৬/৭ টাকা ট্যাক্সি ভাড়ায় আমি চলে আসি আনন্দবাজার এর দালানের নিচে। বেশ পুলকও অনুভব করি। শীর্ষেন্দু কাউকে বলে রেখেছিলেন মনে হলো, গেটে নাম পরিচয় দেবার পর কে একজন তেতলায় একটা ছোট্ট ঘরে আমাকে নিয়ে গেলো। এখানে বসে আছেন স্বয়ং শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।
শীর্ষেন্দুর তেমন কোনো উপন্যাস আমার তখনো পড়া হয়নি। দেশএ ধারাবাহিক বেরিয়েছিল দূরবীন’- সেটার দুটো পর্ব পড়েছিলাম। কথা বললাম তা-ই নিয়ে। টের পেলাম- কোনো লেখকের লেখা কেউ পড়েছেন এবং এ বিষয়ে কথা বলতে এসেছে, এমন বিষয় লেখকেরা, সে যদি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও হন- বেশ পছন্দ করেন। আমাকে চা খাওয়ানো হলো, সিঙ্গারা খাওয়ানো হলো। আমি আনন্দ পাবলিশার্সের বই কোথা থেকে কিনবো, কলেজ স্ট্রিটের কোন দোকানে গিয়ে কোন কর্মচারীর সঙ্গে কথা কালে আমাকে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ ছাড়ে বই দেয়া হবে, সেসবের আলাপ হলো।
 বেরিয়ে যাবার সময় মনে হলো- এ পত্রিকায় সম্পাদক সাগরময় ঘোষের সাথে দেখা করলে খারাপ হয় না। আমার মনের কথা বললাম শীর্ষেন্দুকে। তিনি পাঠিয়ে দেন সাগরময় ঘোষের রুমে।
ছোট্ট একটা কামরা। আলো নাই বললেই চলে। পাখা ঘুরছে ঘটঘট করে। চাদিকে বইয়ের ¯প।
একটা কাঠের হাতল ওয়ালা চেয়ারে বসে আছেন প্রায় আশির কাছাকাছি বয়সের এক প্রবীন। গায়ের রং কালচে, নাদুস নুদুস গড়ন, চোখে চশমা।
সাগরময় ঘোষ সম্পর্কে আমি বেশী কিছু জানি না। শুধু এটুকু যে, তিনি রবীন্দ্রনাথের সরাসরি ছাত্র ছিলেন। শান্তিনিকেতনে পড়াশুনা করেছেন।

আমি কথা শুরু করি রবীন্দ্রনাথ দিয়ে। বলি, তাঁকে কি আপনার মনে আছে? সাগরময় ঘোষ হাসলেন একটু। বললেন, ‘দেশপত্রিকায় যোগ দিয়ে প্রথম যে এসাইনমেন্টটি করেছিলাম তা ছিলো-কবি গুরুর কাছ থেকে একটা কবিতা আর গল্প নেয়। সেটা কবিগুরুর মৃত্যুর কয়েকমাস আগে মাত্র। কথা প্রসঙ্গে বলেন, স্বদেশী আন্দোলন করার জন্য একবার জেলে গিয়েছিলাম। সেই জেলখানায় পরিচয় হয়-আনন্দবাজার এর সম্পাদকের সঙ্গে। তিনিও জেলে। আমার চাকরী হয়ে যায় জেলখানায়। আমাকে তিনটা অপশন দিয়েছিলেন তিনি। আমি নিলাম দেশপত্রিকার চাকরীর কাজ। সেই থেকে আছি। দেশ পত্রিকায় আমার চাকরীর বয়স পঞ্চাশ পার হয়েছে। তবে সম্পাদকের দায়িত্বে আছি এই সেদিন ১৯৭৬ থেকে, ১৪ বছর হলো।
কথা বলতে বলতেই জানি, তিনি আসলে আমাদের বাংলাদেশেরই মানুষ। তার জন্ম আমাদের কুমিল্লায়। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ তেমন যোগাযোগ নাই। এবার আমি গলার স্বর নরম করে, তার সম্পর্কে জানা কিছু অভিযোগের কথা বললাম।
আমি জানতে চাইলাম- মুসলমান লেখকদের নাম কেনো আপনারা বিকৃত করে ছাপেন? যে লেখক আপাদের কাছে লেখা পাঠান, তিনিতো তার নামটি নিজেই লিখে দেন। আপনারা ছাপার সময় তার নাম বদলান কেনো?
থতমত খেয়ে যান সাগরময় ঘোস। বলেন- এটা একেবারেই অনিচ্ছাকৃত। কখনো ইচ্ছাকরে করেন না। কখনো কখনো এমন অভিযোগ তিনি পান বলেও জানান। বলেন, আরবী-ফার্সী নাম বাংলায় অনেকে অনেকভাবে লেখে, কোনটা যে সঠিক নাম আমরাও অনেক সময় বুঝতে পারি না।
জানি, হিন্দি নামকে তর্জমা করে কোলকাতার কাগজে বাংলা করে। মিনাকষী কে মিনাক্ষী, আমিতাভ কে অমিতাভ, দিকষিত কে দিক্ষীত তারা করেন, তাই বলে শামসুর এর সঙ্গের রাহমানকে রহমানকেনো করবেন? ওটা শামসুরের নিজস্ব।
সাগরময় ঘোষ অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার মানুষ। আমার কাছে তাঁর অজ্ঞতার কথা বলাতে আমি বিষয়টি চেপে যাই। কিন্তু তাকে ছাড়িনা। বলি- রবীন্দ্রনাথ যতোটা যেভাবে আছেন নজরুল কিন্তু সেই অর্থে কোনোভাবেই দেশএ নেই। এর কারণ কী- নজরুল নামটি মুসলমান আর তিনি বাংলাদেশে চলে গিয়েছিলেন? তিনিও তো আপনাদের বর্ধমানের লেখক।
হাসলেন সাগরময় ঘোষ। বোঝাতে চাইলেন যে, তিনি রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলকে তাদের প্রত্যেকের অবস্থান অনুযায়ী পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেন। নজরুলকে নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র অসন্মান নেই। নজরুল যে অনেক বড় কবি ছিলেন, গীতিকার ছিলেন সেটাও বলেন।
আমি লক্ষ্য করি, এই প্রজ্ঞাবান সম্পাদক আমার অতি আক্রমনাত্মক কোনো কথায়ই বিন্দুমাত্র অসন্তোষ হচ্ছেন না। বরং হাসি মুখে সব কথার জবাব দিচ্ছেন।
অনেকক্ষণ বসা হলো তার ঘরে। এবার উঠে আসার পালা।
তাঁর কামরা থেকে বেরিয়ে চলে আসবো, এমন সময় আরেকটা খুপরীর দরোজায় লেখা দেখি- দিব্যেন্দু পালিত। তার বই পড়েছি আমি। খুব বেশি নাগরিক জীবন নিয়ে লেখেন।
তেমন কোনো ভদ্রতা না করেই অনেকটা রিস্ক নিয়ে ঢুকে পড়ি দিব্যেন্দু পালিতের কামরায়। আধা মিনিটের মধ্যে বলে ফেলি-কেনো এসে পড়েছি তার ঘরে। দেখলাম, তিনিও অনেক সহজ। আমাকে বসতে বলেন। তাঁর গদ্য কাঠামো নিয়ে কথা বলি। কেমন করে একটা উপন্যাসের চিন্তা মাথায় আসে, একটা চরিত্র চিত্রনের জন্য কি কি উপায় অবলম্বন করেন, সেসব নিয়েও কথা বলি এবং এক সময় বিদায় হই।
আমি সেবার ঢাকা ফেরত এসে আনন্দ বাজারে পয়তাল্লিশ মিনিটশিরোনামে একটা লেখা লিখি এবং পাক্ষিক অনন্যায় জমা দেই। লেখাটি পরের বছর ভ্রমণ সংখ্যাতে ছাপা হয়। এটাই ছিলো কোনো পত্রিকাতে ভ্রমণ বিষয়ক আমার প্রথম লেখা। সেটা ১৯৯১ সাল।

-------------------

আহমেদ স্বপন মাহমুদের ভ্রমণকথা/৫

মৃত পিকাসোকে নিয়ে ব্যবসা তো জীবিত পিকাসোর চেয়ে বেশিই 


পিকাসো মিউজিয়াম থেকে বের হচ্ছি ছবি তুলতে তুলতে। মিউজিয়ামের বাইরে ছবি তোলা নিষেধ নয়কিন্তু দুধের স্বাদ তো ঘোলে মিটে না। অগত্যা নেমে আসছি দ্রুত। ক্ষুধা পেয়েছে সবার। নামার আগেই সিঁড়িতে পায়ে ব্যথা পেয়েছে রোহিণী। তার জন্য অপেক্ষা করা অবশ্য কর্তব্য টিমের সদস্য হিসেবেতাকে তো আর ফেলে যাওয়া যায় না। আমরা কেউ কেউ নিচতলায় পিকাসোকে নিয়ে স্যুভেনির শপে ঢুকলাম। অনেক বইপত্রস্যুভেনির। পিকাসোর ওপর বইপিকাসোর চিত্রকর্মগুলো নিয়ে সুন্দর সুন্দর দামী বইপোস্ট কার্ডভিউ কার্ডগ্লাসখেলনা ইত্যাদি উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখলামকিনলাম না।

ফটো তোলা মিউজিয়ামে নিষেধ হলেও ফটো তোলা চিত্রগুলোর ব্যবসাই তো দেখছি নীচে। মৃত পিকাসোকে নিয়ে ব্যবসা তো জীবিত পিকাসোর চেয়ে বেশিই দেখছি। কম হয় না। ওই যে জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন যে কেঁচো, কৃমি খুঁড়ে খুড়ে অধ্যাপকরা বেঁচে থাকে। বড় টিপপনি কেটেছিলেন তিনি। পিকাসোকে খুঁড়ে খুঁড়ে ব্যবসা মন্দ না! জগতের রীতিই এমন। তাদাহিশা ও বয়িংগিল স্যুভেনির কিনল। রেজা সেলিম ঢুকে বেড়িয়ে গিয়ে গলির মুখে দাঁড়িয়েছেন। এর মধ্যে রোহিণীর পা-টা ঠিকটাক হচ্ছে মোটামুটি। বললাম, এবার চলা যাক সামনে। এগিয়ে এসে কেউ প্রস্তাব রাখল সামনে কিছুদূর হাঁটলেই বিচ, ওখানে গিয়েই না হয় ডিনার সারা যাবে, কেউ জানালো এখানেই আশপাশ রেস্টুরেন্টে ডিনার সারতে। অগত্যা, আমরা খুব বেশি দূর না হেঁটে পাশের একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম।রোহিণীর পা ব্যথাটাও আমাদের বিবেচনায় আছে। বেচারা বেশিদূর হাঁটতে পারবে না। উচ্চতা মনে হয় সাড়ে চার ফুট, ওজনও তার কাছাকাছি! শরীরের ভার দুই পা বহন না করবারই কথা।তো, আমরা গিয়েই নারভিয়ন নামে একটা রেস্টুরেন্টের দোতলায় উঠছি।ওখান থেকে কটমটে মেজাজে ওয়েট্রেস জিজ্ঞাস করলো যে, আমাদের এডভান্স বুকিং আছে কিনা। এডভান্স বুকিং আমাদের থাকবার কথা না। আমরা গিয়ে বসছি। তো আবার মেজাজ কিছুটা তিরিক্কি করে জানালো যে, বিয়ার ১৪ ইউরো, আর সাধারণ খাবার ২৫ ইউরো। ঘটনা কি? দেখলাম লোকজনের ভীড় বাড়ছে।ব্যস্ত সন্ধ্যায় মেজাজ ওর তিরিক্কি হবারই কথা। এমনিতে কিন্তু বার্সেলোনাবাসীকে ভালোই দেখলাম, অনেক সহজ, সাবলীল। প্যারিসে এটা কম দেখছি। প্যারিস লেস ফ্রেণ্ডলি মনে হয়েছে আমার কাছে। এ নিয়ে ওয়াশিংটনে গুগল কনফারেন্স কালীন এক প্যারিসের একজন পরিচিতা তো বলেই বসল যে আমার ধারণা ঠিক না। হয়তো। তবে অনেক অনেক বার গিয়েছি প্যারিস। বিশেষ করে ওইসিডির সাথে পলিসি ইস্যূতে কাজ করতে গিয়ে প্রতি বছরেই দুএকবার যেতে হয়।ভাষা না জানায় তেমন কোনো বন্ধু জুটেনি। দুচার জন পরিচিত জন আছে, মন্দ না। দেখাও তো কালেভদ্রে হয়।তোবার্সেলোনায় যাদের সাথে কথা হয়েছে ওদের চমৎকার মনে হয়েছে। অনেকে ইংরেজিও জানে।ট্যুরিস্ট সামলাতে হয় কিনা।
দাম শুনে আর ওয়েট্রেসের ব্যস্ত মেজাজ দেখে ওখানে খেতে ইচ্ছে করলো না আমাদের কারোরই। দাম চড়া হবার কারণ ভিন্ন। আজ ফ্লেমিংকো অনুষ্ঠিত হবে। বিশেষ ধরনের নাচ গান। আমাদের অঞ্চলে বিশেষ করে ভারতে যেটাকে কথক বলা হয়, এই টাইপের। যায়। ছোট জায়গায় ফ্লেমিংকো কিভাবে হবে আমার মাথায় ধরলো না। আমি ফ্লেমিংকো উপভোগ করেছে আমেরিকায়, ওয়াসিংটন ডিসিতে। মিলেনিয়াম স্টেজে। এটা খুব বেশি দূরে নয় জগতের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে। বারাক ওবামা নিশ্চয়ই ফ্লেমিংকো দেখেছেন, শুনেছেন-- উপভোগ করেছেন পরিবার পরিজন বন্ধুস্বজন, কূটকৌশলীসহ। মিলেনিয়াম স্টেজ মানে বিশাল বড় স্টেজ। বিশাল লম্বা জায়গা। শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে সেটা দেখতে পারে। এক কথায় চমৎকার লেগেছিলো। শিল্পীরা গান গায়, আর সাথে নাচ হয়। আমি দেখছিলাম কেবল পায়ের জুতার সাউণ্ড কী করে চমৎকার বাদ্য হতে পারে। গান তো আছেই। সেই অসম্ভব অনুভূতি মনে হলে আজো তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে হয়। তো, আমার ফ্লেমিংকো না দেখলেও হবে; অন্যরাও দেখছি আগ্রহী না। আমরা নিচে নেমে বসলাম, একই রেস্টুরেন্টে। পাকিস্তানী ওয়েটার এসে জানালো কোনো ডিংক্স লাগবে কিনা। আলবত। দেখলাম ওখানে ক্যাপিরিনহা আছে। চমৎকার ড্রিংক্স। নামটাও অদ্ভুত সুন্দর। আমি খেয়েছিলাম রিও ডি জেনিরোতে। প্রচুর লেবু, আইস আর চিনি দিয়ে তৈরি। একটু কড়া করে তৈরি করলে দুতিন গ্লাস আপনাকে কাবু করে দিতে পারে। তো, আমরা ক্যাপিরিনহায় যাচ্ছি। পাশাপাশি ফুডের সাথে ইনবিল্ট চারটা বিয়ার পাওয়া গেলো। আমরা এমন একটা ডিশ পছন্দ করলাম যাতে ৬ জনের হয়ে যায়। অনেক ভ্যারাইটি এক সাথে খাওয়া যাবে এই সুযোগে। পাকিস্তানী ওয়েটার, নাম মাহমুদ, জানালো যে এটি বেশ ভালো ডিশ। বার্সেলোনায় ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট কম, কিন্তু পাকিস্তানীদের রমরমা রেস্টুরেন্ট ব্যবসা।বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট নাই। আমি জিজ্ঞাস করেছিলাম রাম্বলায় এক বাংলাদেশী স্টেশনারী শপের লোকটাকে। কিন্তু মাদ্রিদে বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টে খেয়েছি এর আগে। সেদিন ছিলো মহাউৎসবের সময়। স্পেন ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশীপ জিতেছে ফুটবলে। বোঝেনই তো, কী তে পারে উৎসব।এবার স্পেন কী খুব ভালো করবে। আল্লা মালুম! ফ্লাবিয়া আসছে আর্জেন্টিনা থেকে। বললাম, বাংলাদেশ তো বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় দুভাগ হয়ে যায়, জানও দিয়ে দিতে পারে এমনকি। শুনে তো অতার চোখ ছানাবড়া। সে দেখলাম আর্জেন্টিনা নিয়ে আশাবাদী না। মেসি থাকলেও জানালো সে, মেসির জন্য দরকার টিম। বার্সা আর আর্জেন্টিনা একা না।
আমরা ক্যাপিরনিহায় আছি, উপরে ফ্লেমিংকো আছে। ছেলে মেয়েরা আসছে, ঢুকছে, জড়িয়ে ধরছে, চুমু খাচ্ছে। আমাদের কানে নাচের আর গলার ভেসে শব্দগুলো আসছে।চোখগুলো চারপাশের কাণ্ড দেখছে, মজা পাচ্ছে, কিন্তু ফ্লেমিংকোর আওয়াজ ভালো লাগছে না।
একটু সময় নিয়ে ডিনার সারলাম, অনেকটা ইউরোপিয় কায়দায়। ওরা খাবারের জন্য বাঁচে, বেশি সময় ধরে খায়, আমরা বাঁচার জন্য খাই, তো হুড়মুড় করে উঠতে হয়, কাজে নামতে হয়। দুএকটা স্যুভেনির শপে ঢুকলাম।মাশাল্লাহ, দাম মাথাচড়া। বিশেষ করে, বিশ্বকাপ সামনে রেখে এফসি বার্সেলোনা মানে বার্সেলানা ফুটবল ক্লাব অফিসিয়ালি বল, টি শার্ট ছেড়েছে বাজারে। একটা টি শার্টের দাম ১০০ ইউরো, বলের দাম ৩০ ইউরো। বাইরের দোকানগুলোতে খানিক কম, কিন্তু বার্সেলোনা স্টেডিয়াম শপে দেখলাম যা তা দাম।বার্সেলোনা স্টেডিয়াম, সে আরেক কাণ্ড। সবটাই তো দখল করে আছে কাতার এয়ারওয়েজ, অফিসিয়াল স্পন্সর। সবকিছুতেই কাতার। ব্যবসা বটে।আমার পছন্দের এযারওয়েজ। সার্ভিসবেশ বেশ ভালো। আমাকে প্রায়শ বিজনেস ক্লাস দিয়ে দেয় কমপ্লিমেন্টারি হিসেবে।ইকোনমিক ক্লাসের টিকেট কাটলেও এবারও বার্সেলোনায় বিজনেস ক্লাসে চলে আসলাম, খেয়ে দেয়ে ঘূমিয়ে আরাম আয়েশে। আরা কেউ কেউ টিশার্ট আর বল নিয়ে ফিরছি। অমিয় বলেছিল বল নিয়ে যেতে তার জন্য। সো কিনতে হয়েছে। আবেগ ও মমতার কাছে অর্থের তেমন কোনো মূল্য থাকে না।
পথে পথে মানুষের ভীড়।পথের পাশে খোলামেলা রেস্টুরেন্টে বসে শত শত মানুষ বিয়ার খাচ্ছে, সিগেরেট ফুকছে, সাংগ্রিয়া নিচ্ছে, ডিনার করছে। কত না সোহাগ আর নৈকট্যের উদ্দীপনায় ভালোবেসে আছে প্রেমিক-প্রেমিকা, বন্ধু ও স্বজনেরা পরস্পর। ভালোই লাগে আমার মানুষদের দেখতে।হাঁটতে হাঁটতে দেখছি সার্কাসে নেমেছে তিন জন ইয়ং ছেলে।তাদের ঘিরে অোছে যেন আরো তিনশ জন। সার্কাস বললে ভুল হবে, শারীরিক কসরত। জিমন্যাস্টিক বলা যায়। চমৎকার। শরীরকে দুমড়ে মুচড়েও যে মানুষদের আনন্দ দেয়া যায়।এ অঅর নতুন কি!এই শরীর একদিন সত্যিই দুমড়েমুচড়ে নাই হয়ে যাবে, স্বাভাবিক, তবুও যে অবাগ লাগে।দেহ ব্যবহার করেই, মানে দেহের শক্তি ও সৌকর্য্য, সৌন্দর্য্য ব্যবহার করেই তো জগৎ চলছে। সেটা কী রিক্সাওয়ালা বা খেলাধুলা, কী দেহ ব্যবসা, পণ্যাপণ্য সবকিছুই!
আমরা জউমি স্টেশনের দিকে এগিয়ে চলছি। রোহিণী পাশেই একটা হোস্টেলে উঠেছে। বেশ শান্তশিষ্ট মেয়ে। এরোটিক্স নামে একটা প্রকল্পে কাজ করেছে বোম্বেতে। এখন ফাঁকা। ইন্টারনেটে বা অনলাইনে নারীদের কিভাবে হেনস্থা হতে হয় এই বিষয় নিয়ে ছিলো এরোটিক্স প্রকল্প। মেট্রো স্টেশনের কাছে রোহিণীকে বিদায় জানাতে হলো। একা যেতে পারবো তো আমরা জিগালাম তাকে। বেশ স্বাচ্ছন্দে বললো যে খুব কাছেই তার হোস্টেল। মিউজিয়াম পেছনে ফেলে পিকাসোকে রেখে আমরা চলে এসেছি খানিকটা দূর। এবার রোহিণীকে একা রেখে আমরা স্টেশনের দিকে চলে যাচ্ছি। এভাবে আমাদের কত কত চেনা মুখ সুদূরে হারিয়ে যাওয়া টেনের মতো হারিয়ে যায়, দূরে চলে যায়, কত সহস্র মুখের সাথে কোনো দিন দেখা হয় না আর, যেমন ফিরে পাওয়া যায় না ফেলে আসা শৈশব, পেছনের জীবন কোনোদিন।কিছু মুখ, কিছু মাযা ও স্মতি তবু বেঁচে থাকে।পিকাসোর কিছু চিত্র মায়া হয়ে গেঁথে রইলো মনে।

৮-৯ জুন ২০১৪ 

আহমেদ স্বপন মাহমুদের ভ্রমণকথা/৪

নারীঘটিত আনন্দ-বেদনাউত্থান-পতনে ঘিরেছিল তার সারাটা জীবন




শেষ পযর্ন্ত পিকাসো মিউজিয়ামে যাবো বলেই পণ করেছি। হোস্টেলে রিসেপশনে মিরেইয়াকে জিজ্ঞাস করলাম মিউজিয়ামের লোকেশন। রোসিও আমাকে আগেই মিউজিয়ামের কথা বলেছিল যে এটা জউমিতে, মন্টকাদায়।তো কথা বলছি মিরেইয়ার সাথে।নানা কথা, কোথায় যাওয়া যায়, কালচারাল হাব কোথায়, শিল্পী লেখকরা কোথায় আড্ডা দেয় বা দেয় কিনা, গ্রানাদায় কী করে লোরকাকে দেখতে যাওয়া যায় এইসব। সে জানালো যে, তার বাড়ি গ্রানাদায়।এ টি কাকতালীয়। রোসিও বলছিল যে তার বাবার বাড়ি আন্দালুসিয়ায়, মিরেইয়া জানাল গ্রানাদায়।ট্যুরিজমে গ্র্যাডুয়েশন শেষ করে চাকুরি নিয়েছে এই কোম্পানিতে। মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে হোস্টেলে উঠেছি এটি মূলত রেসা নামে একটি কোম্পানির, যাদের এই টেক ইউনিভার্সিটির সাথে চুক্তি আছে। স্টুডেন্টরা যেমন থাকতে পারে এখানে, অন্যান্যরাও এখানে থাকতে পারে। ভাড়াটা একটু কম, তুলনামূলকভাবে। যদিও এখানকার ভাড়া নির্ভর করে সিজনের উপর। আমাদের ওখানেও তাই। কক্সবাজার সারা বছর খালি পড়ে থাকে, অল্প ভাড়ায় আপনি থাকতে পারবেন, কিন্তু শীতকালে ভাড়া হয়ে যায় কয়েকগুণ বেশি।এটা কেবল বার্সেলোনা বা ব্রাসেলসে নয়, লন্ডনে, সিউলেও তেমনটিই দেখছি। গত মার্চে সিউলে এক হোটেল বুক করতে গিয়ে দেখি শনি, রোব বারে তাদের ভাড়া বেশি অন্যান্য দিনের তুলনায়। কারণ তখন অনেক ব্যবসায়ী, প্রেমিক প্রেমিকা, কাপলরা বেড়াতে আসে। ভাড়াটা বাড়িয়ে দেয় একটু।
মেট্রোয় চেপে বসলাম আমরা কয়েক জন, এক ধরনের টিম ভাব হয়ে গেছে আমাদের মধ্যে। তো, পাশেই দেখা রোহিণীর সাথে। গতকাল এসেছে, চলে যাবে আগামীকাল। বোম্বে থাকে সে।জানাল, মিউজিয়ামে যেতে তারও আপত্তি নেই।
নেমে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। যেতে যেতে ছবি তুলছি।বা র্সেলোনার রাস্তা ঘাট বিশাল বড় বড়। বিশাল বিশাল গ্রাউণ্ড। সবুজের সমারোহ তো আছেই। প্রচুর গাছপালা। শহরটি একটু হিলি। হাঁটতে একটু কষ্ট হয় বৈকি! এখানে মন ভরে আকাশ দেখা যায়, বিশাল আকাশ; বুক ভরে শ্বাস নেয়া যায়। ঢাকার মতো ধুলা, ধোঁয়া, ট্রাফিক জ্যাম নাই। কিন্তু মানুষ কম না দেখছি। প্রচুর ট্যুরিস্ট তো আছেই। হাঁটিছি মিউজিয়ামের দিকে। এক ধরনের এক্সাইটমেন্ট তো কাজ করছেই। বড় বড় শিল্পীদের কাছাকাছি গেলে কেমন যেন হালকা লাগে নিজেকে, জগতের ভারও মনে হয় কমে যায় অনেকটা। অন্তত এতটুকু সান্ত্বনা আছে যে, পিকাসোকে দেখে যাওয়া হচ্ছে। গার্সিয়া লোরকা, আপনি শান্তিতে ঘুমান গ্রানাদায়, কোনো এক সময় নিশ্চয়ই দেখা হয়ে যাবে।
মিউজিয়ামে যেতে হয় তুলনামূলকভাবে বেশ সরু পথে। তো, আমরা টিকেট কাটলাম ১১ ইউরো দিয়ে প্রত্যেকে। সাথে কিচ্ছুটি নেয়া যাবে না। তবে মোবাইল থাকতে পারে সাথে, কিন্তু ছবি তোলা নিষেধ। মনটা দমে গেল খানিক। ভাবছিলাম, ছবি তুলব। সে গোড়াতেই মাটি। আমরা দোতলায় উঠছি। ছবি দেখছি। ছবির নাম, সন তারিখসহ লেখা। কখন ডোনেট করা হয়েছে মিউজিয়ামে তারও হদিস আছে। ছোট বয়সের ছবিগুলো প্রথমেই চোখে পড়বে আপনার। অনেকগুলো কক্ষ, একেকটা কক্ষে একেক কালপর্বের ছবি। বেশির ভাগ ছবি দেখছি ১৯৭০ সালের দিকে পিকাসো ডোনেট করেছেন মিউজিয়ামে। ছোটবেলাতেই তিনি বড়বেলার কারিশমা দেখিয়েছিলেন ছবি আঁকায়। গ্রেট ট্যালেন্ট হলে যা হয়।মহাত্মা ছাড়া তো আর এমনটি হয়ে না! আমাদের কাজী নজরুলও তেমন মহাত্মাই ছিলেন। ছোটবেলাতেই বড় বেলার মাজেজা কী দেখাতে পেরেছিলেন। এসএম সুলতানও তো কম ছিলেন না।
ছবি দেখছি। হুট করে ভাবলাম কথা বলি একটু। প্রতিটি রুমে এক জন করে পাহাড়ায় আছে, মানে দায়িত্বে আছে। তারা খেয়াল রাখে হয়তো কে কী করে। ছবি তোলা তো নিষেধ। একটি বড় ছবির সামনে দাঁড়িয়েছি। ছবিটি হচ্ছে অন্নপ্রাসনের, লোরকার বোন লোলা ছবিতে, এগিয়ে এসে মেরিনা বলল। আমি পরিচয় দিয়ে জিগালাম সে কবে থেকে এখানে কাজ করছে। মেরিনা জানাল যে, মাস তিনেক, হিস্ট্রি অব আর্টস-এ গ্রেডুয়েশন করে অগত্যা এই চাকুরীতে ঢুকেছে। আমি বললাম, এটা তো মজার চাকুরী, কত মানুষের সাথে দেখা হয়, কত না দেশের, কত না রকমের মানুষ। ভালোই তো।মনে হলোখুব একটা পছন্দের না, কোনোমতে কেটে যাচ্ছে এই জবে।সুযোগ পেলেই বদলে ফেলবে। আমি বললাম যে ছবি কী কোনোমতেই তোলা যায় না? সে মিস্টি হাসি দিয়ে না সূচক জবাব দিলো। মেনে হলো তাদের অগোচরে কেউ যদি তোলেই ফেলে তো ফেলে আর কি।মনে একটু হালকা সাহস নিলাম। কিন্তু যেভাবে রুমে রুমে চোখে চোখে রাখে দেখে ফেললে তো বিপত্তি, শরমেরও বিষয়। কিন্তু নিষেধ মানা কী সম্ভব পিকাসো মিউজিয়ামে এসে। আমি মোবাইলে নোট নিচ্ছি কিছু কিছু চিত্রকলা দেখে। তো, হুট করে ক্লিক মারলাম। নিষেধ অমান্য করার কী যে স্বস্তি, কী যে শান্তি!
অনেক চিত্র। জানা গেল ৪২৫০টির মতো চিত্র আছে এই মিউজিয়ামে। পিকাসোর নবিস ছবিগুলো এখানেই পাওয়া যায়, যখন সবে বালকমাত্র তিনি। এই চিত্রগুলো মূলত ওয়েল অন ওয়াটার, অয়েল অন ক্যানভাস। পাখি নিয়ে, বাড়ঘর নিয়ে, সমুদ্র ও প্রকৃতি নিয়ে ইত্যাদি। রেুমে রুমে সাজানো চিত্রগুলো কালপর্ব র্বিবেচনা করে দেখলে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা, রং ও কাজের পরিবর্তন স্পষ্টতই চোখে পড়বে।কখনো কেবল রেখা, কখনো রঙের বাহুল্য, কখনো ব্লু, সাদা-কালো-লালের মিশ্রন ইত্যাদি। তার সিরামিকসের কাজগুলো দারুণ। সিরামিকসে ৪২টি চিত্র। পিকাসোর মৃত্যর পর তার স্ত্রী জেকলিন ১৮৮২ সালে সেগুলো মিউজিয়ামে ডোনেট করে দেন।
১৯০১ থেকে ১৯০৪ ছিলো পিকাসোর ব্লু পিরিয়ড, ১৯০৫-১৯০৬ রোজ পিরিয়ড।১৯০১-এ প্যারিস যাত্রার পর তার চিত্রে রঙের পর্ব বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই পর্বের চিত্রগুলো রাখা আছে ৮ নম্বর কক্ষে, প্রথমে ঢুকেই নজরে ১৮৯০-১৮৯৫-এর চিত্র। ১ থেকে ১৬টি কক্ষে এবং বি১, বি২ তে চিত্রকর্মগুলো রাখা। ১৬ নম্বর কক্ষে ও বি২ তে তার সিরামিকসের কাজ। এন হচ্ছে নিউ ক্ল্যাসিক্যাল হল। বি১ জউমি সাবার্টেস গ্যালারি। ৯, ১০, ১১ নম্বরে ১৯১৭ সালে বার্সেলোনায় আঁকা চিত্রগুলো। এইভাবে কালপর্বে রাখা।
পিকাসোর নিজের সেল্ফ পোট্রেট আছে। আরো অনেকের পোট্রেট আছে। যেমন বেনেডেটা বিয়ানকন, সেবাস্টিয়া জুনিয়েন্ট, রেমন রিভেনটস প্রমুখের। বিশাল বড় বড়। পিকাসোর স্ত্রী জেকলিনের একটা একটা চমৎকার চিত্র আছে। শাদা কালো। হালকা লাল আছে কোণায়। দুই ধরনের অভিব্যক্তি সেখানে। শাদা অংশটা বেশি আর কালোটা কম। বিষয়টা এমন যে, জেকলিনের ভালোমন্দ গুনাগুণ এখানে রূপায়িত করেছেন শিল্পী। শুধু জেকলিন কেন, মানুষের ভালোমন্দ রূপের চিত্রায়নই এটি। নারীদের নিয়ে আরো ছবি আছে। পোট্রেট আছে। একটা পর্বে দেখলাম অনেকটা ডার্কনেস চিত্রগুলোয়। নারীদের চিত্রগুলো দুএকটা ছাড়া খুব ব্রাইট না।ফিমেল ন্যুড পেইন্টিং ছাড়াও দুএকটা হরর টাইপের চিত্র দেখলাম। যেমন: দ্য ডেড নিউ ব্র্ন বেবি’, ‘এট দ্য সাইড অব এ ডেড ম্যানইত্যাদি।সবচেয়ে মজা লাগছে কেবল ফ্রেমের উপর আঁকা চিত্রকর্মটি। মনে হতে পারে এখান থেকে মনে ছবিটি সরিয়ে রাকা হয়েছে সাময়িক ফ্রেমটা পড়ে আছে। মজার বিশাল ফ্রেম। নারীদের উপর তার চিত্র কম নয়। উইম্যান রেসিস্টিং দ্য এমব্রেস অব ম্যাননামে ছবিতে মেয়েটি পুরুষটি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাইছে। দ্য কিসনামে ছবিটিও দারুণ। এগুলো ১৯০০ সালে আঁকা। এ ধরনের আরো ছবি আছে। অবশ্য, পিকাসোর ব্যক্তিজীবনে নারীদের বাহুল্য ছিল বেশ। নানা অভিজ্ঞতা ও প্রেম-অপ্রেমে তিনি সারাটা জীবনই কাটিয়েছেন। নারীঘটিত আনন্দ-বেদনা, উত্থান-পতনে ঘিরেছিল তার সারাটা জীবন। শিল্পীর জীবন বলে কথা!
মিউজিয়ামটি ১৯৬৩ সালে শুরু হয়। পিকাসোর ঘনিষ্ট বাল্যবন্ধু জউমি সাবার্টেস মিউজিয়ামটির উদ্যোগ নেন। ১৯৩৫ সালে তিনি পিকাসোর পারসোনাল সেক্রেটারি হয়েছিলেন।অন্য অনেকের সহযোগিতায় মধ্য পঞ্চাশে সাবার্টেস মিউজিয়ামের প্রকল্পটি হাতে নিয়েছিলেন।ব্যক্তির উদ্যোগ জড়তের মহান কীর্তি হয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠান টিকে থাকে মর্যাদা নিয়ে, শিল্প ও সৌন্দর্যের অভিব্যক্তি নিয়ে। আর আমরা প্রতিষ্ঠান ভাঙ্গি।প্রতিষ্ঠান তো পারছিই না তৈরি করতে, যেগুলো ছিলো সেগুলোও রাজনৈতিক হানাহানি আর ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে বিনাশ করে ফেলি। আমাদের শিল্পিীদের নিয়ে, কবিসাহিত্যিকদের নিয়ে যাদুঘর কই? আহমদ শরীফ, আহমদ ছফা, হুমায়ুন আজাদ মাপের মানুষ সহসা তো জন্মাবে না। জয়নুল আবেদীন, এস এম সুলতান যুগে যুগে আসে না যে।জসিম উদ্দিনের ওপর তো কিছু করি নি আমরা। শামসুর রাহমান ভালোমন্দ মিলিয়ে কম তো লিখেন নাই। জীবিত অবস্থায় অসম্ভব সৌভাগ্যবান ছিলেন তিনি। মৃত্যুর কবছরের মাথায় আমরা সবই যেন ভুলে যাচ্ছি। হুমায়ুন আহমদের কীর্তি ও কৃতিত্বও তো কম নয়। এমন আরো বহু নাম আছে। আমরা নিজেদের মর্যাদা দিতে জানি না। হন্যে হয়ে পাগলা কুত্তার মতো ছুটছি তো ছুটছিই। লোল পড়া জিহবা আকাশ পাতাল ছুঁয়ে যাচ্ছে, তবু আমাদের লোভের সীমানা দিগন্ত ছুয়ে দেখছে না। আপন মানুষকে, আপন জাতির মহিমাকে মর্যাদা দিতে না জানলে অপরে এসে গরিমা দিবে না নিশ্চয়ই। আপন মহিমা ও কীর্তিকে তুলে ধরা আমাদের বড় কাজ যে। কিন্তু আমরা সেগুলো কদাচিৎ ভাবি। তাইলে জাতি কিসের উপর টিকে থাকবে? আওয়ামী লীগ-বিএনপির মহড়ার উপর জাতি টিকে থাকে না হে!
পিকাসো মিউজিয়ামের আরেকটা বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এক সাথে রক্ষিত আছে ৫৭টি চিত্র, যেগুলোতে ভেলাজকোয়েজের লাস মেনিয়াস-এ শিল্পীর ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন রয়েছে। এগুলো একটা সিরিজ চিত্র। পিকাসো একমাত্র এই চবিগুলোই সিরিজ এঁকেছিলেন। একটার পর একটা ছবি। দীর্ঘক্ষণ তো আর এক ছবি দেখা যায় না, আপনি চাইলেও। দর্শণার্থী অনেক। ফলে আপনাকে এগিয়ে গিয়ে অন্য চিত্রে চোখ-মন রাখতে হবে। বিভিন্ন সময়ের ছবি। করুনা, মালাগা, বার্সেলোনা, মাদ্রিদ, হর্টে দে সান্ট জোয়ান-এ আঁকা চিত্রগুলো তার সলিড একাডেমিক ট্যালেন্সিকে ফুটিয়ে তোলে। তাছাড়া প্যারিসের পিকাসোর ভ্রমণ নতুন মাত্রা দেয় তার চিত্রগুলোয়।ফরাসী শিল্পের নন্দনতত্ত আর বার্সেলোনার মন ও ভঙ্গির মিশ্রন আলাদা রীতি তৈরি করে চিত্রকলার জগতে। শিল্পের জগতে আভাঁ গার্দে মানে ভ্যানগার্ড একটি পরীক্ষামূলক রীতি, যাতে ১৯০০ সালে প্রথম প্যারিস ভ্রমনের পর ঝুঁকে পড়েন শিল্পী। সেই আঁভা গার্দে আন্দোলনের ভাব ও রীতি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও শিল্পের সংস্কার গার্সিয়া লোরকাতেও হাজির। আর ফরাসী শিল্পের নন্দনতত্ব পিকাসো, লোরকা কেন সারা দুনিয়াতেই শিল্পসাহিত্যে চিত্রকলায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।
ছবি দেখে কী হয়। চিত্রকলা।কী আশ্চর্য অনুভূতিময় বিষয়। রং ও রেখায় আঁকা চিত্রগুলোয় কত না মমতা মাখা, বেদনা মাখা, কত না সময়ের দাগ, রাত্রির কালো, দিনের আলো, জীবনের হতাশা, বিষাদ-আনন্দ-গান মিশে আছে। কত না জীবনের অভিব্যক্তি ফুটে আছে চিত্রকলায়। শব্দ নেই কোনো, বাক্য নেই অথচ ভাব আছে, আবেগ আছে, রূপ আছে বহুরূপের। দেখার আনন্দ আছে, ভাবনার বিস্তার আছে। শিল্পের এই মহান কায়দায় জীবন কত যে রকমের ফুটে ওঠে। শিল্পের এই কানুনের সাথে বারবার জীবন নিজে পরাজিত হয়ে জয়ের আনন্দ পায়।
কবিতাও ছবি। কবিতাও চিত্র, চিহ্নে ভরপুর, শব্দ, বাক্য দিয়ে সাজানো অভিব্যক্তির কী আশ্চর্য প্রকাশ কবিতায়। হয়তো চিত্রকলার চেযে আরো দুরুহ, হয়তো বা না। কিন্তু প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত শব্দমালা নিয়ে কবিকে কাজ করতে হয়। ব্যবহার্য জিনিসকে নতুন করে, নতুনের মতো শিল্পে রূপ দেয়া তাই হয়তো একটু কঠিন। রঙের সাথে শব্দের এতটুকু ব্যবধান কবিতাকে, সাহিত্যকে মহত্তম শিল্পরূপ আকারে হাজির করেছে।
বেরিয়ে আসার সময় মেরিনাকে আর দেখিনি। দেখার ইচ্ছাও হয়নি। প্রবেশ বাহির হওয়ার পথও আলাদা। আলাদা আলাদা পথের শিল্প তবু অন্বয়ী, দূরান্বয়ী হয়েও।ছবি তোলা এখন আর নিষেধ নেই।বের হওয়ার পথে তাই মিউজিয়ামের বাইরের দেয়ালের ছবি তুললাম। এ হয়তো কোনো অর্থ বহন করে না, কিন্তু পিকাসোর ছাপ নিয়ে, মর্ম নিয়ে যা বেঁচে আছে তার অর্থ কম কিসে।
দেখা শেষ হয় না, চোখ চলে আসে দূরে, মন গেঁথে থাকে। শিল্পের সৌন্দের্যের ক্লান্তি অনেক। মনে যে কত রকমের প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। মন ভার হয়, হালকা হয়, অবসাদ আসেসবমিলিয়ে একটা ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায় শিল্প। এই ঘোরগ্রস্ততাই হয়তো শিল্পীর জীবনের মহান শক্তি, যা অন্তরের গভীর মায়া ও প্রত্যয়কে, ব্যক্তির শোচনা ও হরষকে, ভাব ও প্রতিজ্ঞাকে নৈব্যর্ক্তিক করে তোলে। শিল্প যে কারণে মহামানবজাতির চিরঅন্বয়, চিরসুন্দরতা।

৬-৭ জুন ২০১৪
====================

আহমেদ স্বপন মাহমুদের ভ্রমণকথা/৩


তারা নোবেল একাডেমির সাথে রীতিমত দফারফা করতে চায়

কথা হচ্ছিলো লিউনার্দোর সাথে। বার্সেলোনা টেক ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসেই তার অফিসএকটি মেম্বারশিপভিত্তিক এনজিওর পরিচালক। এনজিওর অফিস বিশ্বদ্যিালয়েল মধ্যে এটা সহজ নয়অন্তত আমরা ভাবতে পারি না। বাংলাদেশে এনজিওরা ভুঁইফোঁড় আকারে হাজির করেছে নিজেদের। সমাজে মর্যাদা কিছুমাত্র আছে বলে মনে হয় না। কর্পোরেট বিশ্বায়নের কালে নিজেদের মত ও পথ অনুয়ায়ী কাজ করতে পারা সোজা না। অবশ্য সমাজের আগাগোড়া নাই যেখানেসেখানে কেবল এনজিও কেনসাহিত্য সংস্কৃতি মিডিয়া ব্যবসাসরকার অসরকার সবকিছুর অবস্থাই তো জগাখিচুড়ি। কথা কথায় লিউনোর্দো জানালো যেবার্সেলোনাকে বলা হয় সাহিত্যসংস্কৃতির সিটি। সিটিতে অনেক জায়গাতেই সাহিত্যের আড্ডা হয়বিভিন্ন হোটেল রেস্টুরেন্ট পার্ককে ঘিরে এসব আড্ডায় কবি লেখক সাহিত্যিকরা আসেন। বললামআমি এমন কিছুই খুঁজছিএবং তার সাহায্য পেলে জায়গাগুলো ঘুরে দেখতে চাই। ইউরোপের অনেক দেশেই এইটা একটা সমস্যা যদি ভাষাটা আপনার জানা না থাকে। ফ্রেঞ্চ বলেন আর স্প্যানিশ বলেন কোনোটাই জানা নাই আমার। এ নিয়ে বিপত্তি কম নয়বিপদে পড়তে হয় মাঝেমধ্যেই। ওরা আবার ইংরেজি-টিংরেজি পাত্তা দেয় না। তো অগত্যা ভরসা করতে হয় চেনাজানা লোকদের উপর। সেটা সবসময় ভরসার হয় না। সাহি্ত্য নিয়ে তো আর সবার মাতামাতি নেই!


লিউনার্দো জানালো যেবিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অদূরেই একটি পাবলিশিং হাউজ আছেবিখ্যাত হাউজ যারা মূলত লেখালেখি প্রমোট করেকিন্তু এটা ব্যবসার আওতায়। ইউরোপ আমেরিকায় এমনটি পাওয়া কঠিন কিছু না। সাহিত্যকে প্রমোট করার জন্য বহু প্রফেশনাল লবিহাউজলবিস্টপ্রকাশনা আছে। এটা নোবেল প্রাইজ উইনার হোকবুকার হোকবা বেস্ট সেলার হোকতারা এটি করে থাকে ওইসব লেখকদের জন্যও। নোবেল একাডেমির সাথে তো রীতিমত দফারফা করতে চায়। সাহিত্য বাজারের অংশ এইটা মানতে না চাইলেও এইটা এখন বাজারের অংশসাহিত্যেরশিল্পের নিয়তি। বাজার অবশ্য আমাদেরও আছে। তবেএখানে ভালো লেখকদেরকেই প্রমোট করে লবিস্টরাআমাদের ওখনে হয় তৃতীয় শ্রেণীর লেখকদের। প্রফেশনাল প্রকাশনা বা লবিস্ট না থাকলেও আমাদের দেশে প্রথম আলোপ্রথমাবেঙ্গল ইত্যাদি অনেকটাই লেখাজোখা লেখককে বাজারজাত করে।শুধু তা কেনএখনতো বাঙ্গালি সংস্কৃতির ধারকবাহক হয়ে উঠতেছে বেঙ্গল। বিশাখি মেলা থেকে শুরু করে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসর জমানো তাদেরই কাজ। আমাদের সংস্কৃতিপাড়া ওদের হাতেই সঁপে দিয়েছে কূলমান! তবে সবার উদ্দেশ্য কিন্তু একইরকমেরব্যবসা করা। তোআমাদের প্রকাশনা শিল্পটাই দাঁড়ালো না। চকমক করলেই তো সোনা হয় না। রংচং বইয়ের ঢং দেখে চোখ জ্বলে আমার। যা তা অবস্থাবইমলো আসলেই সেইটা বোঝা যায়। প্রকাশনা ব্যবসা আছেআরো নানা ফন্দি ফিকিরের সাথে এইটাও আছেযে কারণে বহু আবর্জনা আর বাজে লেখককে প্রমোট করতে তো চোখের সামনেই দেখছি আমাদের দেশে। এসবের জন্য পুরস্কার প্রদানের হিড়িকও কম নয়। কিন্তু বাইরে বাজে লেখক নেই তেমন নয়কিন্তু বাজে লেখা প্রমোট কম করা হয়। বা করলেও সেগুলো আখেরে ফল পায় না। লিউনার্দো জানালো যে ইউকের একটি প্রকাশনার সাথে কাজ করে এমন একজন লবিস্ট ভদ্রমহিলা সাহিত্যকে বাজারি করার কাজ করেন বার্সেলোনার প্রকাশনাটির সাথে।
বাংলা একাডেমির হে উৎসব’ ওইরকম পরিকল্পনার অংশ কিনা। ডেইলি স্টার তো আছেই। তাহমিমা আনামকে প্রমোট করার পেছনেও তো কাজ করছে প্রকাশনা সংস্থা। দৈনিকটিও কম করেনি। সেইটা অন্য কথা তবে। প্রমোট করতেই পারেদোষের কিছু না। বাংলাদেশে ইংরেজি লেখকদের প্রমোট করাদুচারজনকে বেছে নেয়া বাজারি সাহিত্যের জন্য খুবই দরকারি। গেল বছর হুট করে জানলামপ্রবাসী বাঙালি একজন লেখককে বই প্রকাশের আগেই নামীদামী একটি প্রকাশনা কোম্পানির পেছনে খরচ হয়েছে লাখ পনেরো টাকা। বইটি প্রকাশ হয়েছে বটেদেখেছিও। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত!
আমি বলছিলাম গার্সিয়া লোরকার কথা। আন্দালুসিয়ার কথাকর্দোবার কথা। কর্দোবা আন্দালুসিয়ার কাছাকাছি। আন্দালুসিয়ায় যেতেমানে বার্সেলোনা থেকে ৮০০ কিলোমিটার দূরঘন্টা চারেক সময় লাগবে। মুশকিল হচ্ছে টিকেট পাওয়া যাচ্ছে না। এইটা একটা সমস্যাযদি টিকেট আগে না কাটেন তো কপালে দুর্ভোগ আছে। তিনগুণ বেশি দমেও টিকেট পাওয়া ভার! মুশকিলে পড়ে আছি।


বাংলা একাডেমির হে উৎসব’ ওইরকম পরিকল্পনার অংশ কিনা। ডেইলি স্টার তো আছেই। তাহমিমা আনামকে প্রমোট করার পেছনেও তো কাজ করছে প্রকাশনা সংস্থা। দৈনিকটিও কম করেনি। সেইটা অন্য কথা তবে। প্রমোট করতেই পারেদোষের কিছু না। বাংলাদেশে ইংরেজি লেখকদের প্রমোট করাদুচারজনকে বেছে নেয়া বাজারি সাহিত্যের জন্য খুবই দরকারি। গেল বছর হুট করে জানলামপ্রবাসী বাঙালি একজন লেখককে বই প্রকাশের আগেই নামীদামী একটি প্রকাশনা কোম্পানির পেছনে খরচ হয়েছে লাখ পনেরো টাকা। বইটি প্রকাশ হয়েছে বটেদেখেছিও। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত!
আমি বলছিলাম গার্সিয়া লোরকার কথা। আন্দালুসিয়ার কথাকর্দোবার কথা। কর্দোবা আন্দালুসিয়ার কাছাকাছি। আন্দালুসিয়ায় যেতেমানে বার্সেলোনা থেকে ৮০০ কিলোমিটার দূরঘন্টা চারেক সময় লাগবে। মুশকিল হচ্ছে টিকেট পাওয়া যাচ্ছে না। এইটা একটা সমস্যাযদি টিকেট আগে না কাটেন তো কপালে দুর্ভোগ আছে। তিনগুণ বেশি দমেও টিকেট পাওয়া ভার! মুশকিলে পড়ে আছি।
তো অগত্যা পিকাসো মিউজয়াম যেতে চাই। ক্যাটালুনিয়া থেকে খুব দূরে নয়হাঁটা দূরত্ব। আমার আগ্রহ ছিলো ওখানে গিয়েই ডিনার সারব। কিন্তু রোমানিয়ার রোজি জানালো আশপাশে রেস্টুরেন্ট নেইকেবল জুতার দোকান্। হুমএখানে জুতা আর কাপড়ের দোকানগুলোই মনে হয় বাজার দখল করে আছে।এইচ এণ্ড এম এর বিশাল বিশাল বিল্ডিং। রানা প্লাজা বিপর্যের পেছনে ওদের দায় তো কম নয়। তোমিউজিয়াম ঘিরে জুতার দোকান আমার একটু বেখাপ্পা লাগল। মনে পড়ে গেল রেপ অব দ্য লকর কথা।আলেক্সাণ্ডার পোপ ভালোই রসিক ছিলেন। রীতিমত একটা সামান্য বিষয় নিয়ে মহাকাব্য লিখে ফেললেন।চুল নিয়ে মহাকাব্য বিশ্বসাহিত্যে দ্বিতীয়টা আছে বলে জানা নেই। কিন্তু রেপ অব দ্য লক’ তো আর প্যারাডাইজ লস্ট’ বা মেঘনাদ বধ’ নয়এটা মক এপিক। তোওখানেব বৈসাদৃশ্য বোঝানোর জন্য বাইবেলের পাশে জুতোর উদাহরণ ছিল। মকারিই বটে। পিকাসো মিউজিয়ামের পাশে জুতার দোকানমকারিই মনে হলো।


তো অগত্যা পিকাসো মিউজয়াম যেতে চাই। ক্যাটালুনিয়া থেকে খুব দূরে নয়, হাঁটা দূরত্ব। আমার আগ্রহ ছিলো ওখানে গিয়েই ডিনার সারব। কিন্তু রোমানিয়ার রোজি জানালো আশপাশে রেস্টুরেন্ট নেই, কেবল জুতার দোকান্। হুম, এখানে জুতা আর কাপড়ের দোকানগুলোই মনে হয় বাজার দখল করে আছে।এইচ এণ্ড এম এর বিশাল বিশাল বিল্ডিং। রানা প্লাজা বিপর্যের পেছনে ওদের দায় তো কম নয়। তো, মিউজিয়াম ঘিরে জুতার দোকান আমার একটু বেখাপ্পা লাগল। মনে পড়ে গেল রেপ অব দ্য লকর কথা।আলেক্সাণ্ডার পোপ ভালোই রসিক ছিলেন। রীতিমত একটা সামান্য বিষয় নিয়ে মহাকাব্য লিখে ফেললেন।চুল নিয়ে মহাকাব্য বিশ্বসাহিত্যে দ্বিতীয়টা আছে বলে জানা নেই। কিন্তু রেপ অব দ্য লকতো আর প্যারাডাইজ লস্টবা মেঘনাদ বধনয়, এটা মক এপিক। তো, ওখানেব বৈসাদৃশ্য বোঝানোর জন্য বাইবেলের পাশে জুতোর উদাহরণ ছিল। মকারিই বটে। পিকাসো মিউজিয়ামের পাশে জুতার দোকান, মকারিই মনে হলো।
মশকরা এমন আরো আরো অনেক হয়। সব তো লেখায় ওঠে আসে না। এখন ফিল্ম হয়, ভিডিও হয়, নাটক সিনেমা কতকিছু হয়। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংযের যুগ বলে কথা। ভিডিও জনপ্রিয় বিষয়, ফান ভিডিও যেমন।
ক্যাটালুনিয়া স্টেশনে নেমে বের হতেই বিশাল গ্রাউণ্ড, বিশাল বিশাল বিল্ডিং দাঁড়িয়ে আছে। ফোয়ারার জলগুলো উপরে উঠে নিচে নেমে যাচ্ছে চূর্ণ চূর্ণ জলের কণা ছড়িয়ে। তার পাশে অনেকগুলো ম্যূরাল। এখানে চোখ মেলে দেয়া ছাড়া কাজ কি! বুক ভরে বাতাস নিন। তো দেখলাম চারজন তরুণি হুট করে এসে অভিনয় শুরু করে দিচ্ছে, হালকা নাচের ভঙিমা। ক্যামেরাম্যান ছেলেটাকে দেখে নাদান মনে হলো। আমাদের ওখানেও নাদান লোকের সংখ্যাও কম নয় আর।নাটকের নামে দেশটায় যা হচ্ছে আজকাল, আল্লা মালুম! সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনেরও একই অবস্থা। যার যা খুশি, নাটক সিনেমা প্রকাশনা তৈরিতে নেমে পড়ছে, ব্যাঙ্গের ছাতার মতো টেলিভিশনের যেমন অভাব নাই, ডকুমেন্টারি আর ফিল্ম মেকিংয়ের জন্য ডিরেক্টর আর অভিনেতা, অভিনেত্রীরও অভাব নাই। কিছু একটা লিখলেই স্ক্রিপ্ট হয়ে যায়, কয়েকজন মিলেমিশে ভিডিও করে টিভিতে জমা দিয়ে দিলেই প্রচারও হয়ে যায়। কীই-বা করবে আর। গুম, খুন আর ইয়াবা, পুলিশ র্যা ব আর সরকারের উৎপাতে এইগুলা করতে পারাও কম কথা নয়। জীবন জীবিকা তো চালাতে হবে গুম খুনের আগ পর্যন্ত।
এগিয়ে গিয়ে জিগাইলাম তারা কোনো নাটক তৈরি করছে কিনা। সে বলল যে, একটা ফান ভিডিও তৈরি করতে মাটে নেমেছে তারা। মেয়েরাও বলল যে তারা ফান ভিডিও করছে। অঙ্গভঙ্গি, ভঙ্গিমা দেখেই তাই মনে হয়েছিলো।
লিউনার্দোর মেল করার কথা আমাকে ডিটেল জানিয়ে কোথায় শিল্প সাহিত্যের আখড়া। কিন্তু কই? দেখলাম রোসিওর মেইল। ভাবছি রোসিওকে বলি পিকাসোতে যেতে। একা, না হয়, কাউকে নিয়ে পিকাসো মিউজিয়াম দেখে আসি। নিদেনপক্ষে, পিকাসোকে ঘিরে যদি লেখক কবি শিল্পীদের সাথে দেখা হয় তাইলে মন্দ হয় না!
৫ জুন ২০১৪
কথা হচ্ছিলো লিউনার্দোর সাথে।বার্সেলোনা টেক ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসেই তার অফিস, একটি মেম্বারশিপভিত্তিক এনজিওর পরিচালক। এনজিওর অফিস বিশ্বদ্যিালয়েল মধ্যে এটা সহজ নয়, অন্তত আমরা ভাবতে পারি না। বাংলাদেশে এনজিওরা ভুঁইফোঁড় আকারে হাজির করেছে নিজেদের। সমাজে মর্যাদা কিছুমাত্র আছে বলে মনে হয় না। কর্পোরেট বিশ্বায়নের কালে নিজেদের মত ও পথ অনুয়ায়ী কাজ করতে পারা সোজা না। অবশ্য সমাজের আগাগোড়া নাই যেখানে, সেখানে কেবল এনজিও কেন, সাহিত্য সংস্কৃতি মিডিয়া ব্যবসা, সরকার অসরকার সবকিছুর অবস্থাই তো জগাখিচুড়ি। কথা কথায় লিউনোর্দো জানালো যে, বার্সেলোনাকে বলা হয় সাহিত্যসংস্কৃতির সিটি। সিটিতে অনেক জায়গাতেই সাহিত্যের আড্ডা হয়, বিভিন্ন হোটেল রেস্টুরেন্ট পার্ককে ঘিরে এসব আড্ডায় কবি লেখক সাহিত্যিকরা আসেন। বললাম, আমি এমন কিছুই খুঁজছি, এবং তার সাহায্য পেলে জায়গাগুলো ঘুরে দেখতে চাই। ইউরোপের অনেক দেশেই এইটা একটা সমস্যা যদি ভাষাটা আপনার জানা না থাকে। ফ্রেঞ্চ বলেন আর স্প্যানিশ বলেন কোনোটাই জানা নাই আমার। এ নিয়ে বিপত্তি কম নয়, বিপদে পড়তে হয় মাঝেমধ্যেই। ওরা আবার ইংরেজি-টিংরেজি পাত্তা দেয় না। তো অগত্যা ভরসা করতে হয় চেনাজানা লোকদের উপর। সেটা সবসময় ভরসার হয় না। সাহি্ত্য নিয়ে তো আর সবার মাতামাতি নেই!
লিউনার্দো জানালো যে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অদূরেই একটি পাবলিশিং হাউজ আছে, বিখ্যাত হাউজ যারা মূলত লেখালেখি প্রমোট করে, কিন্তু এটা ব্যবসার আওতায়। ইউরোপ আমেরিকায় এমনটি পাওয়া কঠিন কিছু না। সাহিত্যকে প্রমোট করার জন্য বহু প্রফেশনাল লবিহাউজ, লবিস্ট, প্রকাশনা আছে। এটা নোবেল প্রাইজ উইনার হোক, বুকার হোক, বা বেস্ট সেলার হোক, তারা এটি করে থাকে ওইসব লেখকদের জন্যও।নোবেল একাডেমির সাথে তো রীতিমত দফারফা করতে চায়। সাহিত্য বাজারের অংশ এইটা মানতে না চাইলেও এইটা এখন বাজারের অংশ, সাহিত্যের, শিল্পের নিয়তি। বাজার অবশ্য আমাদেরও আছে। তবে, এখানে ভালো লেখকদেরকেই প্রমোট করে লবিস্টরা, আমাদের ওখনে হয় তৃতীয় শ্রেণীর লেখকদের। প্রফেশনাল প্রকাশনা বা লবিস্ট না থাকলেও আমাদের দেশে প্রথম আলো, প্রথমা, বেঙ্গল ইত্যাদি অনেকটাই লেখাজোখা লেখককে বাজারজাত করে।শুধু তা কেন, এখনতো বাঙ্গালি সংস্কৃতির ধারকবাহক হয়ে উঠতেছে বেঙ্গল। বিশাখি মেলা থেকে শুরু করে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসর জমানো তাদেরই কাজ। আমাদের সংস্কৃতিপাড়া ওদের হাতেই সঁপে দিয়েছে কূলমান! তবে সবার উদ্দেশ্য কিন্তু একইরকমের, ব্যবসা করা। তো, আমাদের প্রকাশনা শিল্পটাই দাঁড়ালো না। চকমক করলেই তো সোনা হয় না। রংচং বইয়ের ঢং দেখে চোখ জ্বলে আমার। যা তা অবস্থা, বইমলো আসলেই সেইটা বোঝা যায়। প্রকাশনা ব্যবসা আছে, আরো নানা ফন্দি ফিকিরের সাথে এইটাও আছে; যে কারণে বহু আবর্জনা আর বাজে লেখককে প্রমোট করতে তো চোখের সামনেই দেখছি আমাদের দেশে। এসবের জন্য পুরস্কার প্রদানের হিড়িকও কম নয়। কিন্তু বাইরে বাজে লেখক নেই তেমন নয়, কিন্তু বাজে লেখা প্রমোট কম করা হয়। বা করলেও সেগুলো আখেরে ফল পায় না। লিউনার্দো জানালো যে ইউকের একটি প্রকাশনার সাথে কাজ করে এমন একজন লবিস্ট ভদ্রমহিলা সাহিত্যকে বাজারি করার কাজ করেন বার্সেলোনার প্রকাশনাটির সাথে।
মশকরা এমন আরো আরো অনেক হয়। সব তো লেখায় ওঠে আসে না। এখন ফিল্ম হয়, ভিডিও হয়, নাটক সিনেমা কতকিছু হয়। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংযের যুগ বলে কথা। ভিডিও জনপ্রিয় বিষয়, ফান ভিডিও যেমন।
ক্যাটালুনিয়া স্টেশনে নেমে বের হতেই বিশাল গ্রাউণ্ড, বিশাল বিশাল বিল্ডিং দাঁড়িয়ে আছে। ফোয়ারার জলগুলো উপরে উঠে নিচে নেমে যাচ্ছে চূর্ণ চূর্ণ জলের কণা ছড়িয়ে। তার পাশে অনেকগুলো ম্যূরাল। এখানে চোখ মেলে দেয়া ছাড়া কাজ কি! বুক ভরে বাতাস নিন। তো দেখলাম চারজন তরুণি হুট করে এসে অভিনয় শুরু করে দিচ্ছে, হালকা নাচের ভঙিমা। ক্যামেরাম্যান ছেলেটাকে দেখে নাদান মনে হলো। আমাদের ওখানেও নাদান লোকের সংখ্যাও কম নয় আর।নাটকের নামে দেশটায় যা হচ্ছে আজকাল, আল্লা মালুম! সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনেরও একই অবস্থা। যার যা খুশি, নাটক সিনেমা প্রকাশনা তৈরিতে নেমে পড়ছে, ব্যাঙ্গের ছাতার মতো টেলিভিশনের যেমন অভাব নাই, ডকুমেন্টারি আর ফিল্ম মেকিংয়ের জন্য ডিরেক্টর আর অভিনেতা, অভিনেত্রীরও অভাব নাই। কিছু একটা লিখলেই স্ক্রিপ্ট হয়ে যায়, কয়েকজন মিলেমিশে ভিডিও করে টিভিতে জমা দিয়ে দিলেই প্রচারও হয়ে যায়। কীই-বা করবে আর। গুম, খুন আর ইয়াবা, পুলিশ র্যা ব আর সরকারের উৎপাতে এইগুলা করতে পারাও কম কথা নয়। জীবন জীবিকা তো চালাতে হবে গুম খুনের আগ পর্যন্ত।
এগিয়ে গিয়ে জিগাইলাম তারা কোনো নাটক তৈরি করছে কিনা। সে বলল যে, একটা ফান ভিডিও তৈরি করতে মাটে নেমেছে তারা। মেয়েরাও বলল যে তারা ফান ভিডিও করছে। অঙ্গভঙ্গি, ভঙ্গিমা দেখেই তাই মনে হয়েছিলো।
লিউনার্দোর মেল করার কথা আমাকে ডিটেল জানিয়ে কোথায় শিল্প সাহিত্যের আখড়া। কিন্তু কই? দেখলাম রোসিওর মেইল। ভাবছি রোসিওকে বলি পিকাসোতে যেতে। একা, না হয়, কাউকে নিয়ে পিকাসো মিউজিয়াম দেখে আসি। নিদেনপক্ষে, পিকাসোকে ঘিরে যদি লেখক কবি শিল্পীদের সাথে দেখা হয় তাইলে মন্দ হয় না!

৫ জুন ২০১৪

আহমেদ স্বপন মাহমুদের ভ্রমণকথা/২
----------------------------------------
শিল্পসাহিত্যের স্পেনে এখন নতুনদের জন্য কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে



বার্সেলোনা টেকনোলজি ইউনিভার্সিটির জর্দি গিরোনোর হোস্টেল থেকে বের হয়ে মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ, কাছেই পালাও রিয়েল মেট্র্রো স্টেশন। চেপে বসলাম ট্রেনে। আজ আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন ফিলিপাইনের আল আলেগ্রে, বাংলাদেশের রেজা সেলিম।হামাদা, বয়িংগিল, সিয়াংহো, মানাভি তো আছেই। রেজা সাথে দেখা কয়েক বছর পর। দেশে যোগাযোগ হয়ে ওঠে না। নগরের ব্যস্ততা অনেক কিছুর সাথে আমাদের সম্পর্কগুলোও কেড়ে নিয়েছে। আরবান লাইফে সম্পর্কের মর্যাদা কদাচিৎ মেলে।ভাঙন যে কেবল আরবানে তাও নয়, এখন তো গ্রামেও একই অবস্থা। সোসাইটির যে হারমোনির কথা আমরা বলি গর্ব করে তা উবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আমরা কী টের পাচ্ছি? স্যানটাস এস্টাসিওতে মেট্রো চেঞ্জ করে ডিয়াঙ্গল গিয়ে নামলাম। উদ্দেশ্য কাসা মিলা দেখা। স্টোন দ্বারা তৈরি প্রাচীন প্রাসাদ। এই প্রাসাদের ডিজাইনার গাউদি। তাকে নিয়ে মিউজিয়ামও বলা যায় এটিকে।শত বছরেরও আগে এটি করেছিলেন গাউদি। সেখানে তিনি থাকতেনও। ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তভুক্ত এটি।নন্দিত আর্কিটেক্ট গাউদি, শিল্পীত ডিজাইন। হাজার হাজার দর্শক আসেন প্রতিদিন এটি ভিজিট করতে। ১৫ ইউরো টিকেট। তো পৌঁছে দেখলাম হাতে সময় এক ঘন্টাও নাই। আটটায় বন্ধ হয়ে যাবে। রিসেপসন থেকে দায়িত্বরত মেয়েটি জানালো সময় কম, অল্প সময়ে অনেক কিছু দেখা যাবে না। কিন্তু চায়নার বন্ধুটি দেখবেই। তিনি কাজ করেন ইউনেস্কো হেডকোয়ারটারে। প্যারিসে। আমি আল আলেগ্রে আর সেলিম ভাই গেলাম না। ভাবলাম ঘুরে দেখি আশপাশ। সময় নিয়ে এসে দেখা যাক খন এই হচ্ছে আমাদের প্ল্যান।
তো আমরা লাগোয়া সুভ্যেনির শপ লা প্যাডেরাতে ঢুকলাম। নানা ধরনের স্যুভেনির। এটা লাইব্রেরি নাতবু কিছু বইপত্র আছে। স্প্যানিশে।হুট করে দেখিজর্জ অরওয়েল। নাঅ্যানিমেল ফার্ম বা নাইনটিন এইটি ফোর না। বইয়ের নাম হোমেজ টু কাটালনিয়া।নাইনটিন এইটি ফোর নামে আরো একজন খ্যাতিমান লেখকের বই আছে। হারুকি মুরাকামির। টোকিওতে বন্ধু হামাদাসহ ঘুরছি। ঢুকলাম লাইব্রেরিতে। ২০১০ সালের দিকে হবে। কোনো ইংরেজি বই পাই নি। এই সমস্যা কেবল টোকিওতে নয়। ইংরেজিতে অনূদিত বই পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। প্যারিসেই বলেন বা ব্রাসেলসেমাদ্রিদ বা মেক্সিকো সিটিসিউল ইত্যাদিতে কদাচিৎ পাওয়া যায় সেইসব দেশের সাহিত্যের বইগুলো। ফিকশন যদি দুএকটা মিলেও কবিতার বই পাওয়া ভার। তোতারাতা বলল (হামাদার ডাক নাম তারাতা) মুরাকামির সর্বেশেষ প্রকাশিত নতুন বই। নাইনটিন এইটি ফোর। পরে আমি ওয়াসিংটন থেকে মুরাকামির বইটি কিনি। আমার পছন্দের লেখক। তাকে প্রসঙ্গ করে সম্ভবত কবিতাও লিখেছিলাম। বেশ জনপ্রিয় লেখক তিনি। আমাদের নন্দিত লেখক হূমায়ুন আহমেদ মৃত্যুর আগে মুরাকামি নিয়ে লিখছিলেন প্রসঙ্গক্রমে তার কোনো এক লেখায়। মুরাকামির দুএকটা অনুবাদও বাংলায় চোখে পড়েছে সাময়িকীর পাতায়।অনুবাদ ভালো লাগে নি। মুরাকামি এখন লেকচার দিয়ে বেড়ান দেশে দেশে। ডাকসাইটে লেখক। যেকোনো এয়ারপোর্টে দোকানগুলোতে বেস্ট সেলিং বুক হিসেবে মুরাকামি পাচ্ছেন আপনি। বেশ কবার নোবেল পেতে পেতে ফসকে যাচ্ছে। বেচারা!
দোকানে খুব ভীড় নেই। কেউ কেউ ঘুরে দেখছে জিনিসপত্র। যেমনটি অমরা দেখছিদাম দেখছিকোনো কিছু পছন্দ হচ্ছে না তেমন। কিনবই বা কী। মনে হলো দুএকটা নোট খাতা কিনি। নোট খাতালাইটার ও কলমের প্রতি আমার তীব্র টান আছে। সুযোগ পেলেই কিনে ফেলি। কিন্তু জর্জ অরওয়েল উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে ভাবতে লাগলাম আন্দা লুসিয়ার কথা। মহান প্রাণ কবি গার্সিয়া লোরকার কথা। লোরকা তো সেই কবেই পড়েছি। গেল কবছর আগে আবার সাজ্জাদ শরিফের অনুবাদে বের হয়েছে। আটকুঠুরি একটা অনুষ্ঠানও করেছিলো সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রেঢাকায়। সেখানে গিয়েছিলাম। বইটি কিনেছিপড়েছিও। অনুবাদ মন্দ হয়নি। বেশ কিছু কবিতার বেশ ভালো অনুবাদ আছে।
মাথায় তখন আন্দালুসিয়াকর্দোভাআর লোরকা।তো ভাবলামএবার ঘুরে যাবো। বেশ কবার স্পেনে আসলেও মাদ্রিদের বাইরে যাওয়া হয় না। এবার আন্দালুসিয়া পেয়ে বসেছে। ভাবলামদোকানিকে কিছু জিগাই। ক্যাশে যে মেয়েটি বসে আছে তাকেই জিঞ্জাস করি কিভাবে যেতে হয়কত দূর পথ ইত্যাদি।ওর সাথে সম্বোধন করে আলাপ তুললাম। দেখলামসেও কথা বলতে আগ্রহী। সে এক টুকরা কাগজ বরে করে লিখছেআমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে। আমাদের মানে আমি আর রেজা সেলিম। আমি বললাম যে আন্দালুসিয়ায় যেতে চাই লোরকার সাথে দেখা করতে। সে জানা্লো যে তার বাবার বাড়ি আন্দালুসিয়ায়মায়ের কাটালুনিয়ায়সে জন্মেছে বার্সেলোনায়ভাই থাকে মাদ্রিদ ইত্যাদি। সাথে সাথে জানিয়ে দিচ্ছে কিভাবে ট্র্রেনে করে যাওয়া যায়৮০০ কিলোমিটার হবে বার্সেলোনা থেকে। হাইস্পিড ট্রেনে ঘন্টা চারেক সময় লাগবে।সে জানালো যে খাবারের জন্যও আন্দালুসিয়া বিখ্যাত। শাদা কাগজের মতো আন্তরিক মেয়েটির প্রাণভরা হাসি মুগ্ধতা বাড়িয়া দিলো।
আমি জানতে চাইলাম মেয়েটি কী করে মূলত। পড়াশুনা কীপার্টটাইম চাকুরী কিনা ইত্যাদি। এইসব প্রশ্ন করা প্রাইবেসি লং্ঘনের সামিল হয়ে পড়ে। কিন্তু ওর আন্তরিকতা ও উচ্ছলতা দেখে মনে হচ্ছে আলাপে আপত্তি নেই তার।তো আমাদের আলাপ চলছে। সেলিম ভাই অনুমতি নিয়ে আইফোন দিয়ে ক্লিক করছেন। 
ওর নাম রোসিও জানালো। শিল্পী। ছবি আঁকে। ইলাস্ট্রশেন করে। আর্টে গ্রেজুয়েশন শেষ করে চাকুরি নিয়েছি শপিং স্টোরে।রোসিও জানালো যেইলাস্ট্রশেনের জব পাওয়া অত সহজ না এখানে। বুঝলাম অর্থনৈতিক মন্দা স্পেনের মাথা খারাপ করে দিয়েছিল একটু বেশিই। কাটিয়ে উঠতে চাইলেও এখনো তো বেকারত্বের হার ২৬ শতাংশ্। শিল্পসাহিত্যের ইতিহাসে স্পেনের কদর থাকলেও এখন নতুনদের জন্য জব কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এখানকার মানুষজন একটু পেশানেটআন্তরিক। মাইগ্রেশন নিয়ে ঝামেলা আছে। মরক্কো থেকে যখনতখন চলে আসে। কিছুদিন আগে এ নিয়ে তো হাঙ্গামাও হয়েছিলো। খোদ ইউরোপের অপরাপর দেশগুলোতে রাইট উয়িং সরকারগুলো অভিবাসনের বিপক্ষে। কিন্তু জগতের ইতিহাস পাল্টে দেয়া তো যায় না। মানুষের সভ্যতার ইতিহাস অভিবাসন দিয়েই শুরু।
কথা বলছিরোসিও এঁকে বুঝিয়ে দিচ্ছে কোথায় কীহাসছে। পিকাসো মিউজিয়াম খুব দূরে নয় জানালো সে। পিকাসোকেও দেখে যেতে চাই। অদ্ভুত কিছু বিষয় আছে আমার। যেমন কবরখানা ঘুরে দেখা। কবরখানা তো প্রাণের সমাহার। কবর দেখতে যে খুব ভালো লাগে তেমন নয়কিন্তু কবরে শায়িত শত শত প্রাণান্ত মানুষশত মনীষা। এদের দেখতে গেলে মন ভার ভার হয়জগতেরজীবনের বিচিত্র রূপ ও সংস্কারের কথা মনে আসে। প্যারিসের প্যালেসেসে গিয়ে তো রীতিমত ভিমরি খাওয়ার অবস্থা। বিশাল। অ্যাপোলিনিয়র থেকে শুরু করে জিম মরিসন। কত সহস্র মনীষা শুয়ে আছেন নিরবে। গেল মাসে লণ্ডন গিয়ে বানহিল ফিল্ডস বারিয়্যেল গ্রাউণ্ডে ঘুরে দেখলাম কবরে শায়িত প্রিয় কবি উইলিয়াম ব্লেকসাথে তার স্ত্রী ক্যথরিন সোফিয়া। অতীতের সাথে সম্ভবত মানুষের সম্পর্ক ভবিষ্যতের চাইতেও গভীর।
রোসিও তার ওয়েবসাইট জানিযে দেখে মন্তব্য করতে বলল। আমিও বিজিটিং কার্ড দিয়ে বললাম যে, আমার নেক্সট বইয়ের কবার তার দ্বারা ডিজাইন করাতে চাই। সে সম্মতি জানিয়ে হাসল।
শাদা পৃষ্টার মতো হাসির উচ্ছ্বাস চোখের আড়ালে রেখে মনে মনে আনন্দ নিয়ে বেড়িয়ে আসলাম লা পেডরেরা থেকে। রোসিরা নিশ্চয়ই আরো অনেক বড় হবে। জগতের বহুরূপ ইলাস্ট্রেশনের সাথে রোসিরও জীবন ইলাস্ট্রেশনময়, শিল্পিত হবে নিশ্চয়ই।ততদিনেও জীবনের জন্য জীবন হারিয়ে আমাদের সংগ্রাম চলবেই!
৪ জুন ২০১৪

-----------------------------------------


আহমেদ স্বপন মাহমুদের ভ্রমণকথা/১






অদ্ভুত সব নিয়মরীতি। কথিত উন্নত দুনিয়ায় কত কিছু যে হয়!
আমরা বন্ধুরা মিলে বেড়াতে গিয়েছিলাম সন্ধ্যায়, বার্সেলোনায় রাম্বলায়। কলম্বাসের বিশালমূর্তি আসমানের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে থাকা যায় না বেশি সময়। দেখার কেবল আনন্দ আছে তা নয়, বিরক্তিও আছে হে!
জাপানের হামাদা তাদাহিশা, কোরিয়ার বয়িংগিল ওহ, রোমানিয়ার রোজি, চায়নার সিয়ংহো, কম্বোডিয়ার মানাভি আর আমি। সবে ৬ জন মেট্রো করে চলে গেলাম ড্রাসানেসে বিচ দেখতে। কিন্তু পৌছলাম বন্দরে। সেটা মন্দ হয় নি।
সময়টা ছিল সন্ধ্যা হয় হয়। এখানে ৮টাও সূর্যের তেজ মেটে না। কিন্তু আমাদের ক্ষুধার তেজ বাড়তে থাকে। ফলে ভাবলাম ডিনারটা সেরে নেয়াই ভালো হবে। মানাভির কথা অনুযায়ী যে রেস্টুরেন্টে বসলাম সেটা রীতিমত ডাকাত। সার্ভিসের যে অবস্থা ঢাকায় হলে মেজাজ খারাপ হতো। কিন্তু এখানে মেজাজ ধরে রাখাই উত্তম। তারপরও ডেকে বললাম দুতিনবার খাবারটা দিয়ে দিতে। কেননা আমরা একটু ঘুরে দেখতে চাই আশপাশ। কেবল খাবারের পেছনে এমন স্বর্ণালি সন্ধ্যাটা মাটি করার কোনো মানে হয় না।
খাবারের দাম জেনে মনে হইলো ইউরোপের যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। তাপাও রেস্টুরেন্ট, রাস্তায়, কিন্তু দাম দেখে মনে হয় ফাইভ স্টারে খাচ্ছি। তা খাবারের দাম যাই হোক এক গ্লাস বিয়ারের দাম দেখে তো আচানক! ১০ ইউরো দিয়ে এক গ্লাস বিয়ার ইউরোপ, আমেরিকায় কোত্থাও খাই নি এখনো। খেতে হলো বার্সেলোনায়, বাট, বেশ ভালো। আমাদের চায়নার বন্ধুটি নিল সাংগ্রিয়া। সে রীতিমতো হতাশ। চেখে দেখলাম নিজেও। আপনার ঠোঁটমুখ খিচে আসবে অভ্যাস না থাকলে। বিটার এন্ড সা্ওয়ার, দামেও তেমন। বাট ইটস পপুলার ড্রিংক্স হিয়ার।অসম্ভব চমৎকার রং।
খেয়েদেয়ে আমরা ঘুরে ঘুরে দেখছি, ছবি তুলিছি। ভূমধ্যসাগরের তীরে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে নিশ্চয়ই খারাপ লাগার কথা না। সেবার ২০০৫-এ গিয়েছিলাম তিউনিসিয়ায়।মানে কার্তেজে।সেটাও ভূমধ্যসাগরের তীরে। ইয়াসমিন বিচ।বড়ই সৌন্দর্য্য। সুন্দরীদের আনাগোনায় বেশ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে বিচ।ছিলাম এভরোয়েস হোটেলে। সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারাও ছিলেন সে হোটেলে।বিচসংলগ্ন হোটেল। শাদা শাদা বালির সাথে মাদা শরীরগুলো মিশে গিয়ে স্ফটিকময়তা তৈরি করে। আপনার মনও চনমনে হয়ে উঠবে। চনমনে কেবল সুন্দরীদের নয়, যে কারো জন্যে, বিশেষ কেরে প্রেমিক প্রেমিকা, ভ্রমণপিপাসুদের জন্যে চমৎকার তিউনিসের ইয়াসমিন বিচ।ইয়াসমিন বিচে ঘুরতে যেয়ে নিজেরে খুব নাদান মনে হইছিলো। আপনি একা, বন্ধুবিহীন, স্বজনবিহীন, পরিবারবিহীন সৌন্দর্যের আঁচে গেলে মন তিক্ত হয়ে ওঠে। গাছেদের বাগানে একা একা আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছেদের মতো নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হয়। বেদনা একা বহন করা যায়, কিন্তু আনন্দানুভূতি শেয়ার করতে হয়। নইলে মন তিক্ত হয়ে ওঠে।ভূমধ্যসাগরের জল হাতে নিয়ে মনে হয়েছিল জল ছুঁড়ে মারি কোথাও, কারো দিকে। কিন্ত একা জলকেলি হয় না মনের মতো। আপনার পাশে কেউ নেই। অগত্যা নিসঙ্গতা পিঠে করে বয়ে নিয়ে চলতে হয়! এবার বার্সেলোনায় অন্তত সঙ্গী আছে। ঠাণ্ডা ঝিরঝির হাওয়া বইছে। বাতিগুলো জ্বলে উঠছে। আর তীরে বিশাল বিশাল জাহাজ, স্পিড বোট। পাশের দালানগুলো আলোর বাতি নিয়ে জ্বলে উঠছে ঝিলমিল ভূমধ্যসাগরের পানিতে। আমরা ছবি তুলছি, কথা বলছি, খানিক এগিয়ে ব্রিজে ওপর ছবি তুলছি।একে অপরকে তুলছি, অন্যকে ডাক দিয়ে সবাই একসাথে তুলছি। মানুষ সম্ভবত ছবি খুব পছন্দ করে। যেমন নিজেরটা করে অন্যেরটাও মনে হয় কম পছন্দ করে না। এই কারণেই কিনা ছবিসমেত নায়ক/নায়িকা/সেলিব্রেটিদের সারা দুনিয়াতেই ভিউকার্ডের বিশাল বাজার আছে। ফেসবুকেও যে লেখার চেয়ে ছবিতে লাইক বেশি পড়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জগত! বিড়ম্বনাও কম নয় এই জড়তে। ব্রিজ পার হয়ে অদূরে শপিংমলে ঢুকলাম ঘুরতে, দেখতে। কোনো কেনাকাটা নয় একদম। কাচের মলে আমাদের মুখগুলো খণ্ড খণ্ড ভেসে উঠছে। মানুষের সম্ভবত স্বতন্ত্র ও একক মুখ বলতে কিছু নেই! দুনিয়ার খণ্ড খণ্ড সব মুখ এক হয়ে বিশাল হা করে আছে!
শত শত মানুষ। ঘুরছে, ছবি তুলছে, চুমু খাচ্ছে, বসে থাকছে, বুক ভরে বাতাস নিচ্ছে। উদ্দাম।গরিব দেশের অবস্থা যেমন শুকনা, মানুষের মুখগুলোও সেরকম উদ্যমহীন। ইউরোপ আমেরিকায় গরিবানা আছে বাট উদ্দামতার কমতি নেই। আমোদের সংগ্রাম করতে করতেই জীবন চলে যায়, ইউরোপে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্যর জন্য সেরকম সংগ্রাম করতে হয় না যে।সৌভাগ্য নিয়ে যে সময়ে কোনো শিশূ ইউরোপে, আমেরিককায় জন্মে, ঠিক তার উল্টো, দুর্ভাগ্য নিয়ে একই সময়ে আফ্রিকায়, এশিয়ায় জন্মে নতুন প্রাণ।কী যে নির্মম নিয়তি প্রাণের! একই প্রাণের কত খণ্ড খণ্ড বিচিত্র রূপ। আমরা হাঁটছি আর দেখিছি, খণ্ড খণ্ড হয়ে অখণ্ড দৃশ্যগুলো কাচের দালানে ধাক্কা খেয়ে জলে ভেসে উঠছে, কাচে ভেসে উঠছে। যত্তসব মজার মজার মানুষ, মানুষের মুখ আর অভিব্যক্তি। মুখেদের দিকে তাকিয়ে থাকা আমার নেশা বটে। কত যে এক্সপ্রেসন। শত সহস্র মুখের অভিব্যক্তি, কত যে বৈচিত্রময়। জগত কত যে রকমের!
মজার কান্ড! না, রীতিমত ভয়ংকর। বলছিলাম রীতিনীতির কথা। এই বার্সেলোনায় পিকপকেটিং রীতিমত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কেউ যেকোনো সময় আক্রান্ত হতে পারেন। যে কারণে অনেকেই দামি ফোনসেট, টাকাপয়সা নিয়ে বের হন না। এটা আফ্রিকায়, এশিয়ায় হতে পারে যেন আমরা ধরেই নেই। কিন্তু ইউরোপেও, ল্যাটিন আমেরিকাতেও কমন ব্যাপার। নিউইয়র্কের কথা সবাই তো জানি। নাইরোবিতে, ঘানায় এইরকম ভীতিকর অবস্থার মুখে পড়তে হয়েছে কতবার। কয়েকজন একসাথে ছাড়া তো নাইরোবিতে বেরই হতাম না। মানুষের ভয়। এবার মেক্সিকোতে গিয়েও একই অবস্থা। হোটেলে টাকাপয়সা ফোন রেখে বের হতাম মেক্সিকো সিটির রাস্তায়।বার্সেলোনাতেও এই রকম ভয়! এই কাপঝাপের দুনিয়ায় সব শহরের রীতিনীতি প্রায় এ্কই রকমের!কিন্তু বলি, ইউরোপের অন্যান্য দেশে, কানাডায়, সিঙ্গাপুর, হংকং, মালেশিয়া, এমনকি নেপাল, ইন্ডিয়ায় ছিনতাইকারীর ভয় আসে নাই মনে।তাই বলে কী ছিনতাই নেই, আছে।
আমরা ফিরে আসছি। মেট্রোতে উঠব উঠব। তো হুট করেই দুজন ছিনতাইকারীরা জাপানি বন্ধুটির পা আটেকে দিল উঠার সময়। আর অন্য ছিনতাইকারী হামাদার পকেট থেকে মানিব্যাগ তুলে নিল হাতে। হামাদাও নাছোর বান্দা। ছিনতাইকারীর হাতে ঘুঁষি মারল খসে। মানিব্যাগটি ট্রেনের মধ্যে নিচে পড়ে গেল, হামাদাও পড়ে গেল। দেখলাম দুজন স্মার্ট ইয়ং ছিনতাইকারী। ঘটনাটি মুহুর্তের মধ্যেই ঘটল কোনো কিছু বুঝবার আগেই। আচানক!
বার্সেলোনা ধানমণ্ডি নয়। কিন্তু ধানমণ্ডির চেয়ে কম নয়। ফারুক ওয়াসিফের ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে মোবাইল টাকা পয়সা খোয়ানোর খবর জানলাম আমরা। পরের খবরটি সুমন রহমানের। এলাকা ধানমণ্ডি। অভিজাত এলাকা বটে! মডেল থানাও আছে সেখানে। ভাবলাম, ধানমণ্ডির ছিনতাইকারীর সাথে বার্সেলোনার ছিনতাইকাররীদের কোনো যোগসাজস আছে কিনা। তারা উভয়পক্ষই তো আরবান! এরা যে সবসময় আরবান পুওর তা কিন্তু নয়। ঢাকায় তো শুনি বড়লোকের পোলারা ছিনতাইয়ের সাথে জড়িত। কেবল ছিনতাই কেন, চুরিডাকাতি খুনখারাবিও করে শুনি।ভাড়াও কাটে, হায়!
হ্যা, অদ্ভুত নিয়মরীতি। এখানে ছিনতাইকারীরা ধরা পড়লে তেমন কোনো বিচারআচার হয় না। তিনশ ইউরোর নিচে ছিনতাই করে ধরা পড়লে পুলিশ অফিসে সামান্য জরিমানা দিয়ে তারা পার পেয়ে যায়। তিনশো ইউরোর বেশি হলে খানিক ঝামেলা পোহাতে হয়। ঢাকার সাথে বার্সেলোনার বড় পার্থক্য এখানেই। পাবলিকের হাতে মার তো আছেই, ছিনতাইকারীদের জেলজরিমানা হরহামেশা ব্যাপার। শুধু তা কেন, কয়েক বছর আগে তো ছিনতাইকারীদের পুড়িয়ে মারার, পিটিয়ে মারার হিড়িক পড়ছিল ঢাকায়। ধানমণ্ডির ১৩ নম্বরে থানার কয়েক হাত দূরে এক ছিনতাইকারীকে সিএনজিতে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল চোখের সামনে। কিচ্ছুটি করতে পারিনি সেদিন।অসহায়, নিজের মুখে নিজের পায়ে লাত্থি মারারও জো নেই আমাদের। পুড়িয়ে মারা যে কী ভয়াবহ দৃশ্য! অথচ দেখেন, এই বার্সেলোনার সোসাইটি কত ছিনতাইকারী ফ্রেণ্ডলি। এই্ ফ্রেন্ডলি সোসাইটিতে ঢাকার ছিনতাইকারীরা যোগ দিলে কত ভাল হয়। বেচারারা কেন যে কবি লেখক সাংবাদিক শিক্ষকদের টার্গেট করে!
সামান্য ছিনতাই! সামান্য বললে কম বলা হয়। ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে মরতে হয়েছে এমন ঘটনাতো আছেই আমাদের। তবে গুম, খুনের সমাজে অসামান্য কায়দায় আরবান ছিনতাই অতি সামান্যই বটে!
দুনিয়ায় কত যে আজব কাণ্ড, আজিব নিয়মরীতি!

৩ জুন ২০১৪

1 টি মন্তব্য:

  1. ভ্রমণ বিষয়ক বেশ কয়েকটি লেখা পড়লাম। বেশ ভালো লাগল। লেখকদের এবং সম্পাদককে ধন্যবাদ এমন সুন্দর আয়োজনের জন্য।

    উত্তরমুছুন